Site icon Aparadh Bichitra

ম্যানেজার ওটি বয় পিয়নরাই অবৈধ ক্লিনিকের মালিক

সারাদেশে চিকিত্সাসেবার নামে রমরমা ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে অর্ধলক্ষাধিক প্রতিষ্ঠান। আবাসিক বাড়িঘর, হাটবাজার, অলিগলিতে রয়েছে এসব অবৈধ, নামসর্বস্ব ও নিম্ন মানের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আগে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যারা ম্যানেজার, পিয়ন ও ওটি বয়ের দায়িত্ব পালন করতেন, তাদের অনেকেই এখন এসব অবৈধ ক্লিনিকের মালিক হয়েছেন। আর এসব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্থায়ী চিকিত্সক, দক্ষ টেকনিশিয়ান, নার্স, আয়া বা অন্যান্য স্টাফ না থাকায় চিকিত্সার নামে চলছে অপচিকিত্সা।

চিকিত্সক না থাকলেও তাদের সিল-স্বাক্ষর দেওয়া খালি প্রেসক্রিপশন থাকে এসব অবৈধ ক্লিনিকগুলোতে। সিজার করা হয় ওটি বয়দের দিয়ে। এতে অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। অনেকে মারাও যায়। এভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। আর এসব অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অপচিকিত্সায় কেউ মারা গেলে কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই যেন টনক নড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। শুরু হয় তদারকি। আসলে তদারকির নামে কিছুই হয় না। কিছু দিন অতিবাহিত হলেই আগের মতো অবস্থা। অবৈধ ক্লিনিকের মালিকরা প্রতি মাসে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাসোহারা দিয়ে থাকেন। এ কারণে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনরা সব কিছু জানালেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না।

গত সোমবার সকালে রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিত্সা নিতে গিয়ে হাসপাতালের কর্মীদের মারধরে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম নিহত হন। পুলিশ প্রাথমিকভাবে এটিকে হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছে। পরে জানা যায়, মাইন্ড এইড হাসপাতাল অবৈধ। এই ঘটনা নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

এদিকে আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে সারা দেশের সব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তথ্য দিতে সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। এসব তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতি মাসেই অভিযান চালানো হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, অনুসন্ধান করে সারা দেশের সব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ জন্য জরুরি বৈঠক করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলার সিভিল সার্জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একারপক্ষে এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয় জানিয়ে প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা চান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। এ সময় তিনি বলেন, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম নিহতের ঘটনা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুতপ্ত।

এর আগে গত আগস্টে দেশের সব লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য চেয়ে সব বিভাগীয় পরিচালক ও জেলা সিভিল সার্জনদের চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এছাড়া যেসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে তাদের লাইসেন্স নবায়নের জন্য ২৩ আগস্ট সময় বেঁধে দেয় অধিদপ্তর। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ আহমেদ ইত্তেফাককে জানান, তাদের জনবল খুবই সীমিত। একজন পরিচালক, দুই জন ডিডি, চার জন এডি ও দুই জন মেডিক্যাল অফিসার দিয়েই রাজধানীসহ সারাদেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর দেখভাল করা দুরূহ। তারপরও সাধ্যমতো মনিটরিং করা হচ্ছে। এডির পাঁচটি পদের মধ্যে একটি পদ শূন্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখায় যে জনবল তা দিয়ে সারাদেশ তো দূরের কথা, রাজধানীই দেখভাল করা সম্ভব না।

হসপিটাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, তাদের প্রায় ১৪ হাজার সদস্য আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও একই তথ্য জানিয়েছে। তারা সবাই লাইসেন্সধারী ও নবায়নপ্রাপ্ত। যাদের বৈধ লাইসেন্স আছে ও নিয়মিত নবায়ন করে থাকে তারাই শুধু অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে তিনি জানান।

এই কমিটির একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় একটি সম্মেলনে যান তিনি। সেখানে গিয়ে সরেজমিন দেখেন, ৭৫ ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিক ডাক্তার নন। আগে যারা হাসপাতাল-ক্লিনিকের ম্যানেজার, পিয়ন কিংবা ওটি বয়ের দায়িত্ব পালন করতেন তারাই এখন মালিক হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ১৪ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। আর অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৩ হাজার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা অর্ধ লক্ষাধিক।

এদিকে বিভিন্ন সময় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, আটক করে জেলে পাঠায় এবং জরিমানাও করে। অভিযুক্ত ক্লিনিকগুলো সিলগালাও করে দেওয়া হয়। কিন্তু নানা কৌশলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচলই থাকে। প্রতি অর্থবছরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন নবায়ন করা বাধ্যতামূলক।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা মাসোহারার বিনিময়ে নিবন্ধন না করা অর্ধ লক্ষাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিককে বছরের পর বছর অবৈধ বাণিজ্য চালাতে সহায়তা করছে। কিন্তু মোবাইল কোর্টের অভিযান কিংবা রোগী মৃত্যুর ঘটনায় বড় ধরনের হইচই ঘটলেই ‘হাসপাতালের নবায়ন নেই’ বলে তারা নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়। তখন সাময়িক সময়ের জন্য ঐ হাসপাতাল, ক্লিনিক বন্ধের নোটিশ পাঠানোর মধ্যেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে। সেই বন্ধের নোটিশ কেউ মানল কি না, তা তদারক পর্যন্ত করে না।