সততা ও বিবেক যেন তারুণ্যের চালিকাশক্তি হয়

0
402

গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা গেটে এসেছি। পরিচিত দোকানে গেলাম মোবাইল ফোনে ফ্ল্যাক্সিলোড করতে। আমি আমার নম্বরটি লিখে ৪০০ টাকা লোড করতে বললাম। দোকান মালিক যথারীতি টাকা পোস্ট করলেন। কিন্তু আমার সেটে তথ্য এলো না। অল্পক্ষণেই বুঝলাম শেষের একটি নম্বর ভুল লিখেছি। টাকা চলে গেছে অন্যত্র।

আমি দোকান মালিককে ভুলের কথা জানিয়ে আবার টাকা ভরতে বললাম। শুনে তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, স্যার! এ নম্বরে ফোন করে বুঝিয়ে বলুন। ভালো মানুষ হলে ফেরত পাঠাবে। তবে ছাত্রদের হাতে পড়লে ফেরত পাবেন না। আমি কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। আমাদের শিক্ষকদের খুব কাছের মানুষ তো স্নেহের ছাত্ররাই। ওদের ওপর সাধারণ মানুষ এত বিরাগ কেন! তবে ভদ্রলোক অসাবধানে বোধহয় সাধারণীকরণ করে ফেলেছেন। সব ছাত্রের প্রতি তিনি নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ নন।

আরও দু’বছর আগের কথা। আমার এক আত্মীয়া ঢাকার নিউমার্কেটে কাঁচাবাজার করতে গিয়েছিলেন; কিন্তু বাজার না করে তড়িঘড়ি চলে আসতে হল তাকে। তিনি বাজারে ঢুকতেই দোকানিদের সঙ্গে একদল ছেলের ঝগড়াঝাটি দেখতে পেলেন। লোকজন বলাবলি করছিল, চাঁদা-টাদা নিয়ে কী সব ঝামেলা হয়েছে। হঠাৎ অনেকেই পালাতে লাগল। ঝাপ পড়তে লাগল দোকানের। একদল ছাত্র নাকি আসছে ঢাকা কলেজের দিক থেকে। হাতে লাঠিসোটা আছে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমার আত্মীয়াও দ্রুত ফিরে এলেন বাড়িতে।

এ দুই ঘটনা দেখে ও শুনে আমার একই ধরনের ভাবনা তৈরি হয়েছিল। আমার কাছে যথার্থ মনে হতো, যদি ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকানি বলতেন, স্যার! যদি নম্বরটি কোনো ছাত্রের হয়; তবে অবশ্যই টাকা ফেরত পাবেন। আর নিউমার্কেটের পরিবেশ এমন হতে পারত- একদল ছাত্র আসছে শুনে সবাই নিশ্চিন্ত হতো; এবার এসব ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে দেবে ছাত্ররা।

আসলে নানাভাবেই মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমার কৈশোরের সময়গুলো মনে করতে চেষ্টা করলাম। পারিবারিক ও স্কুলের শিক্ষায় সবকিছুর পরও ভালো ছেলে হওয়ার অর্থাৎ ভালো মানুষ হওয়ার প্রেরণা দেয়া হতো বেশি। সে যুগে ক্লাব সংস্কৃতি ছিল। পাড়ায়-মহল্লায় নানা নামে তরুণদের ক্লাব ছিল।

তখন তো লেখাপড়ার পাশাপাশি সময় কাটানো আর নির্মল আনন্দের জন্য এখনকার মতো এত উপাদান ছিল না। খেলাধুলার পাশাপাশি তরুণ-যুবারা স্বেচ্ছাশ্রমে নানা সমাজকর্মেও ঝাঁপিয়ে পড়ত। মানুষের একটু বেশি আস্থা ছিল ছাত্রদের ওপর। ওদের মানবিক ও ন্যায়পরায়ণ মনে করত। এ কারণেই সম্ভবত দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে যে কোনো আন্দোলন ও সংগ্রামে ছাত্ররাই এগিয়ে আসত।

আমি চার যুগ আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রত্বকালীন কথা স্মরণ করি মাঝেমাঝে। সে সময় বিভাগ ও ছাত্র সংখ্যা ছিল কম। সবার মধ্যে হৃদ্যতা ছিল বেশি। ইট বিছানো রাস্তা ছিল ভেতরে। বিশাল ক্যাম্পাসে ক্লাস টাইমে কিছু বাসট্রিপ ছিল। অন্য সময় হেঁটেই চলাফেরা করতে হতো। এক সময় ভেতরে রিকশা চলাচল শুরু হল। আমরা তখন শিক্ষক, মহিলা বা সিনিয়র কাউকে দেখলে রিকশা তাদের জন্য ছেড়ে দিতাম; ডেকেও দিতাম। এটি সব ছাত্রেরই যেন সাধারণ শিষ্টাচার ছিল।

এখন প্রায়ই দেখি, রিকশার জন্য শিক্ষক দাঁড়িয়ে আছেন, বাচ্চা কোলে নিয়ে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, দাঁড়িয়ে আছেন বয়সী কেউ। স্ট্যান্ডে রিকশা নেই। এ অবস্থায় একটি রিকশার দেখা মিললেই পেছন থেকে একটি চড়া কণ্ঠে ডাক আসে ‘মামা…’। ‘রিকশা মামা’র সাধ্য কি টগবগে তরুণ ভাগ্নের ডাকে সাড়া না দেন। তিনি রিকশার প্রতীক্ষায় থাকা অসহায়দের পাশ কাটিয়ে ভাগ্নের কাছে চলে যান। আর এ যুগের ছাত্রটি শিক্ষক, ক্লান্ত মহিলা আর নানার বয়সী বৃদ্ধের দৃষ্টির সামনে দিয়ে বিজয়ী বীরের মতো চলে যায় রিকশায়, পায়ের ওপর পা তুলে।

ক্যাম্পাসে এমন দৃশ্য এখন প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে; পীড়া দেয়। আমি ভাবি, বিবেক কি তবে তারুণ্যের ভেতর এখন কাজ করে না! পারিবারিক শিক্ষা কি আর তেমনভাবে পায় না ওরা! আমরাও নিশ্চয়ই কিছু শেখাতে পারছি না। আমার অনেকদিন পাবলিক বাসে চড়া হয় না। জানতে ইচ্ছে করে, পারিবারিক শিক্ষার কারণে এবং বিবেকের পীড়নে আমরা অনেক কষ্টে পাওয়া বাসের সিটটি দাঁড়িয়ে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রীকে বিনয়ের সঙ্গে বসতে দিয়ে দিতাম। এ প্রজন্মের ছেলেরা কি এখন এটুকু স্বার্থ ত্যাগ করে? হয়তো কেউ কেউ করে।

এসব থেকে এ অর্থ করা চলে না যে, এখনকার কিশোর-তরুণরা সবাই বখে গেছে। কেউ কেউ বখে গেছে। তবে অন্যায় আচরণ চোখে বেশি পড়ে বলে সুবোধদের কথা সামনে আসে না। পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব আর অনেকটা একাকিত্বে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের মধ্যে আচরণগত সংকট চোখে পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভার্চুয়াল জগতে অবাধ বিচরণ। তবে মানতেই হবে, সবচেয়ে বেশি নষ্ট হওয়ার পথ করে দিচ্ছে শিষ্টাচারহীন রাজনৈতিক শক্তির অপতৎপরতা। এখন স্কুল ছাত্রদেরও কিশোর গ্যাং বানিয়ে বেয়ারা দাপুটে করে তোলা হচ্ছে।

বাংলা সাহিত্যে অনেক কবি-সাহিত্যিকই তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন। বলেছেন, তরুণ জরাগ্রস্ততায় ভোগে না। এ জরা শুধু দৈহিক নয়-মনস্তাত্ত্বিকও। তরুণ সতেজ। সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী। তরুণ সাহসী, উদ্ভাবনী চিন্তা থাকে তার মধ্যে। ফলে অসুরকে তাড়িয়ে সুরের প্রতিষ্ঠা করে সে। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এদেশের ছাত্র আন্দোলন ও গণআন্দোলনে তরুণেরই নেতৃত্ব ছিল। কারণ, তরুণ ছিল নির্লোভ-নির্ভয় দেশপ্রেমিক।

তারুণ্যের শক্তিকে খ্রিস্টপূর্ব যুগে চীনে কনফুসিয়াস আর গ্রিসে দার্শনিক সক্রেটিস ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তারা তরুণদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার পথ দেখাতে চেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, তারুণ্যের শক্তি ছাড়া সুস্থ জীবন আর রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। তবে অন্যায়কারী গ্রিসের রাজাসহ তৎকালীন অভিজাতরা চিন্তা করলেন, তারুণ্যের এ উত্থান তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা-মতবাদ ও সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দেবে। এ কারণে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল সক্রেটিসকে।

আজ এতকাল পর কী দেখছি আমরা! আমাদের দেশে তারুণ্যের দাপুটে অংশকে সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার পথ দেখাচ্ছে। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে পেরেছিল। একইসঙ্গে গৌরবজনক প্রতিবাদী আন্দোলনের চারণভূমি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অবশ্য তখন পরিপ্রেক্ষিতও ছিল আলাদা। স্বাধীন পাকিস্তানে পরাধীন হয়ে পড়েছিল বাঙালি।

তাই মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ-ভাবনাকে মনে জায়গা দেয়নি। দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধিকার আন্দোলনে। আইয়ুব খান এনএসএফ তৈরি করে এ সুন্দর পরিমণ্ডলকে বিষাক্ত করতে চেয়েছিলেন। রক্তক্ষরণ হয়েছে, কিন্তু সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সুবিধাবাদের বীজবপন করে বৈপ্লবিক চেতনাকে নিবীর্য করে দিতে পারেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আইয়ুব খানের আরাধ্য কাজ সুচারুভাবে বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখল স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতাপিয়াসী রাজনৈতিক দলগুলো। স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রয়োজন অনেকটা ফুরিয়ে গেছে।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে সচেতন মানুষগুলোর নির্মোহ রাজনৈতিক চেতনা হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়। শিক্ষার অধিকার, সামাজিক অধিকার, সুস্থ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ সব ক্ষেত্রে আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। একমাত্র নব্বইয়ের গণআন্দোলন ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ভুবন তেমন কোনো আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করতে পারেনি। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মোহগ্রস্ত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেড়েছে। দলীয় সুবিধাবাদ প্রতিষ্ঠায় এসব দলের ক্রীড়নকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহমুক্ত ঐক্যবদ্ধ শক্তির সম্ভাবনার জায়গাটিকে ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। দলীয় রাজনীতির আস্তাবল বানাতে থাকে।

কিন্তু মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্রকে এভাবে দলিত-মথিত করা কঠিন। মোহগ্রস্ত করে ছাত্রদের একটি ছোট অংশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্যাম্পাসে তাদের লেজুড় সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এসব সংগঠনের ক্ষমতার উত্থান-পতন ঘটতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই মূল দলের ইঙ্গিতে ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা উন্মত্ত আচরণ করতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার কল্যাণ চিন্তার বদলে মূল দলের নির্দেশ পালনেই ব্যস্ত থাকে। এ আসুরিক পরিবেশে নিজেদের গুটিয়ে নেয় মেধাবী মুক্তচিন্তার শিক্ষার্থীরা। সংখ্যায় সিংহভাগ হলেও এরা একাকী হয়ে যায়। বলা যায়, নিবীর্যও হয়ে পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তারুণ্যকে সুপথে পরিচালনা করার সুযোগ ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও আশির দশক পর্যন্ত থানা-জেলা থেকে জাতীয় পর্যায়ে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ছিল সক্রিয়। এসব সংগঠন ঘিরে তরুণদের নান্দনিক চিন্তা ও দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার একটি পথ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে রাজনীতিতে বিবদমান দলের অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যুক্তিবুদ্ধির রাজনীতি ক্ষমতার রাজনীতিতে এসে নিজের গৌরব হারিয়ে ফেলে। গণতন্ত্র চর্চার চেয়ে শক্তির চর্চা বেশি হতে থাকে। এ পথে তারুণ্যের একটি সরব অংশ অশুভ রাজনীতিকদের ক্রীড়নকে পরিণত হতে থাকে।

সবকিছুর পরও আমরা প্রত্যাশার জায়গাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। রাজনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংশ্লিষ্ট আমরা অনেকেই আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আদর্শ এমন দাবি করতে পারব না। যত নষ্ট সময়ই যাক, তবুও আমরা মনে করি, তরুণ প্রজন্মই সুন্দরের স্বপ্ন বুনে এবং নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম লালন করে। তারুণ্যের ইচ্ছা আর শক্তি ছাড়া সভ্যতার চাকা ঘুরিয়ে দেয়া যায় না।

এ কারণে আমরা আমাদের প্রত্যাশার জায়গা থেকে বলব- দায়িত্বশীলতার বোধ থেকে এবং সংকীর্ণ স্বার্থবাদী চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের বুকে যদি কিছুটা দেশপ্রেম অবশিষ্ট থাকে, তবে তার সন্ধান করতে চাই। এর খোঁজ পেলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে তারুণ্যকে অন্ধকার থেকে বের করে আনা।

দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করে সুস্থ চিন্তায় বিকশিত হতে দেয়া। দেশের সর্বত্র সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করে তোলা। এসব সংগঠনে তরুণ নেতৃত্ব ও তারুণ্যের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা। ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার পরিবেশ তৈরি করা। সততা ও বিবেক যেন তারুণ্যের চালিকাশক্তি হয়। এ ছাড়া সুবাতাস প্রবাহিত হওয়ার আর কোনো পথ আছে বলে আমরা মনে করি না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nineteen − eight =