মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির পর তা খালাস করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ও ক্লিয়ারিং পারমিট (সিপি) জালিয়াতির অভিযোগে দায়ের মামলায় ফেঁসে গেলেন আমদানিকারক। নজিরবিহীন এ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের পর এবার গ্রেফতার হলেন পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকার মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জলিল (৫৪)। তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের একটি দল। পরে তাকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এ নিয়ে চাঞ্চল্যকর মামলাটিতে এখন পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হল। শনিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহনেওয়াজ খালেদ। তিনি জানান, শুক্রবার রাতে মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জলিলকে পুলিশের সাইবার ইউনিটের একটি দল আটক করে। পরে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। ইতোমধ্যে তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে। গ্রেফতার আমদানিকারককে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন জানানো হবে।
সিআইডির এ কর্মকর্তা বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট জালিয়াতির ঘটনায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারক জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। আমদানিকারকের পক্ষে এলসি খোলা হয়েছিল। তাই তার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এছাড়া এ জাল-জালিয়াতিতে কিছু মধ্যস্বত্বভোগীও জড়িত। আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফের পক্ষে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী কমিশনের ভিত্তিতে অবৈধ উপায়ে পণ্য খালাসের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এই পণ্য খালাস চেষ্টায় জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট খান এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্স বাতিল করা হচ্ছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, এ মামলায় এর আগে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা হলেন- সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের খান এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মওলা খান, তার ছোট ভাই গোলাম রসুল খান, জাল ওয়েবসাইট ডেভেলপার আবুল খায়ের পারভেজ এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ওয়েবসাইট ডেভেলপারের সঙ্গে সমন্বয়কারী মো. আতিকুর রহমান রাসেল ও রাহাত হায়দার চৌধুরী রানা। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সিআইডির তথ্যমতে, রাসেল ও রানা নামের দুই ব্যক্তির ফরমায়েশ মতো আবুল খায়ের পারভেজ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের অনুরূপ একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। এরপর জাল ক্লিয়ারিং পারমিট সেই ভুয়া ওয়েবসাইটে আপলোড করে পণ্য খালাসের চেষ্টা করা হয়। এ দু’জনের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সম্পর্ক রয়েছে।
মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা পণ্য খালাসের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভুয়া ওয়েবসাইট খুলে জালিয়াতির অভিযোগে গত ২৯ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও জাল-জালিয়াতির ধারায় বন্দর থানায় মামলা করেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী শুল্ক কর্মকর্তা সুজয় দেবনাথ। মামলাটি প্রথমে পুলিশ তদন্ত করলেও পরে দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডিকে।
জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ার পর পরই সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান খান এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে লাইসেন্সটি স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার (লাইসেন্স শাখা) সুলতান মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স বাতিলের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে খান এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্স স্থগিত (সাসপেন্ড) করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, ঢাকার মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৩ হাজার ৫২০ কেজি চীনাবাদাম ও ৪ হাজার ৫১০ কেজি অলিভ ঘোষণায় একটি চালান আমদানি করা হয়। আমদানিকারকের পক্ষে চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল চট্টগ্রাম নগরীর শেখ মুজিব সড়কের প্রগ্রেসিভ টাওয়ারের খান এন্টারপ্রাইজ।
চালানটির শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় ২১ হাজার ৬০ কেজি ঘোষণাবহির্ভূত ‘নেসলে লেকটোগ্রো ফরমুলেটেড মিল্ক পাউডার ফর চিলড্রেন’ পাওয়া যায়। যা আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ এর অনুচ্ছেদ ১৭ অনুযায়ী শর্তযুক্ত পণ্য।
কাস্টম সূত্র জানায়, চালানটি খালাসের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হুবহু একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়। তাতে আপলোড করা সিপির কপিটিও ছিল জাল। কাস্টম কর্মকর্তারা জাল-জালিয়াতির বিষয়টি উদঘাটন করতে সক্ষম হলে পণ্য চালানটির খালাস শেষ পর্যন্ত আটকে যায়।