স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানী মহাখালীতে প্রায় তিন বছর আগে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয় ঠিকাদার দিদার হোসেন সজীবকে। ওই ঘটনায় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে বিল্লাল নামের একজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিল্লাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছিরের সহযোগী। বিভিন্ন সময় কাউন্সিলর ও তার স্বজনের পাশে বিল্লালকে দেখা গেছে। এমন কিছু ছবি সমকালের কাছেও রয়েছে। এলাকার লোকজন গোপনে বলাবলি করেন, বিল্লালের মতো শুটাররাই কাউন্সিলরের ‘প্রিয় পাত্র’। তবে ভয়ে কেউ এ নিয়ে টুঁ শব্দও করেন না।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, কাউন্সিলরের সহযোগীরা এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তিগুলোর একটি সাততলা বস্তি রয়েছে এ এলাকায়। এই বস্তিতে অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন কাউন্সিলরের সহযোগীরা। অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি, গৃহস্থালির বর্জ্য অপসারণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসাও তাদের দখলে। এসব খাত থেকে আসা কোটি টাকার বড় অংশই যায় কাউন্সিলরের পকেটে। এমন বহু অভিযোগ নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যে কয়েকটি লিখিত অভিযোগের তদন্ত ও ছায়াতদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। অভিযোগ, কাউন্সিলরের সহযোগী চক্রের বিরুদ্ধে কথা বললেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সম্প্রতি এক সাংবাদিককে বেধড়ক পেটায় তারা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে কাউন্সিলর মো. নাছির সমকালকে বলেন, বিল্লাল নামের কাউকে আমি চিনি না। আমার আশপাশে কখনও কোনো খারাপ লোকজন থাকতে দিই না। প্রতিপক্ষ আমার নামে অপপ্রচার চালায়। ঠিকাদারকে গুলির ঘটনায় জড়িতদের আমিই পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি। বস্তিতে অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের পক্ষেও আমি নই। তাই বৈধ সংযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। তবে তারা এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অবশ্য করোনার সুযোগে মাদক ব্যবসা কিছুটা বেড়েছে।
মহাখালী, গুলশান-১ লিঙ্ক রোড, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও নিকেতন এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে পড়েছে মহাখালীর সাততলা বস্তির বিশাল এলাকা। বড় এ বস্তির মধ্যে রয়েছে আলাদা নামে ছোট ছোট কয়েকটি বস্তি। এগুলো হলো- পোড়া বস্তি, আদর্শনগর, হিন্দুপাড়া, লালমাটি, ঝিলপাড়, স্টাফ মহল্লা, ওয়্যারলেস গেট, চৌধুরীপাড়া ও আইপিএইচ বস্তি। এসব বস্তিতে অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিয়ে মাসিক চাঁদা আদায় করেন গ্যাস মজিবর, আলমগীর, মানিক, কাঠ দুলাল, আলমাস, জালাল, আকবর, ইউসুফ, আশরাফ, সীমা, আবুল, নিয়ামত, মিজু, মামুন, সাদ্দাম, দাদা খালেক, রফিক, মোদাচ্ছের, মোতালেব, শাহ আলম, সুলতান, এস কে আলম, অটো শামীম, হেনা, সবুজ ও জাহানারা।
বস্তিবাসীকে দিতে হয় গ্যাসের একক চুলার জন্য ৬০০ ও দুটি চুলার জন্য এক হাজার ২০০ টাকা। এই হিসাবে মোতালেব ও মোদাচ্ছের গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে মাসে চার লাখ টাকা পান, যা থেকে গ্যাস সংযোগ বাবদ মজিবরকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সাততলাসহ অন্তত তিনটি বস্তিতে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন মজিবর। আলমগীরের লাইনের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি। তিনি মাসে আড়াই লাখ টাকার মতো পান। আর গ্যাস-বিদ্যুতের এসব চক্র নিয়ন্ত্রণ করেন কাউন্সিলর নাছিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত আতর আলী।
আইসিডিডিআর,বি গেট থেকে সাততলা ও জনস্বাস্থ্য গেট থেকে সাততলা রুটে চলাচল করা অটোরিকশা ঘিরেও আছে বাণিজ্য। দুই রুটে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রিকশা চলে। প্রতি রিকশা থেকে প্রতিদিন ৩০ টাকা করে তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে একজন চালককে দিতে হয় ৯০০ টাকা। সেইসঙ্গে প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। অর্থাৎ এক অটোরিকশা থেকে মাসে নেওয়া হয় দুই হাজার ৪০০ টাকা। সব মিলিয়ে এই খাত থেকে চাঁদা ওঠে মাসে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা। এই টাকার বড় অংশই কাউন্সিলর পান বলে অভিযোগ রয়েছে। চাঁদা তোলার কাজ সমন্বয় করেন আতর আলী।
ঘনিষ্ঠ সহযোগী আতর আলীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর বলেন, আতর আলী ভালো লোক। তিনি বস্তিতে অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ ও মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করেন। এ জন্য কেউ কেউ তাকে পছন্দ করে না। তারাই নানা রকম মিথ্যা কথা ছড়ায়।
তবে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আতর আলী অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলেন, ‘কোন… কইছে আমার নাম? পরমাণ দিতে হইব। আমার সামনে আইসা বলুক দেহি।’
নিজেকে কাউন্সিলরের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে তিনি দাবি করেন, অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। বরং তিনি একাধিকবার এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা করেছেন। কয়েক দিন পরই আবার সেই সংযোগগুলো দেওয়া হয়। বিএনপির লোকজন এর সঙ্গে জড়িত। তারা আতর আলীকে ৫০০ টাকাও দেন না। আর পানির সংযোগ এখন বেশিরভাগই বৈধ।
আতর আলী স্বীকার করেন, ওয়ার্ড এলাকার বিভিন্ন বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এ থেকে আসা টাকা তার পকেটে ঢোকে। সেইসঙ্গে অটোরিকশা থেকে আদায় করা চাঁদার কিছু অংশও তিনি নিয়মিত পান।
এদিকে, আনিসুল হক ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র থাকাকালে প্রতিবন্ধীদের মধ্যে বিতরণের জন্য ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে ১৬০টি অটোরিকশা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিবন্ধীদের কাছে এর নগণ্য অংশই পৌঁছেছে। বেশিরভাগ অটোরিকশা ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় অন্যদের কাছে হস্তান্তর করার অভিযোগ রয়েছে।
অস্ত্রধারীর পাশে কাউন্সিলর: অভিযোগ রয়েছে, কাউন্সিলরের আশপাশে সর্বদা সন্ত্রাসীদের আনাগোনা দেখা যায়। সমকালের হাতে আসা কিছু ছবিতে দেখা যায়, হত্যাচেষ্টা মামলায় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার বিল্লালের সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন কাউন্সিলর। তার স্ত্রীসহ অন্যান্য স্বজনের সঙ্গেও বিল্লালের বেশ কিছু ছবি রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঠিকাদারি-সংক্রান্ত বিরোধে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মহাখালীতে দিদার হোসেন সজীবকে গুলি করা হয়। এ ঘটনায় কাউন্সিলরের সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার তৎকালীন এসআই (বর্তমানে পল্লবী থানায় কর্মরত) মিল্টন দত্ত জানান, বিল্লাল ও দীপকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদেরসহ মোট চারজনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়। অপর দু’জন হলো জাবেদ ও হাসিব।
কাউন্সিলরকে ভয় পান সবাই: বনানী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম জসিম উদ্দিন বলেন, এলাকার সব অপকর্মের নিয়ন্ত্রণ করেন কাউন্সিলরের লোকজন। এক ময়লার ব্যবসা (বর্জ্য অপসারণ) থেকেই প্রতি মাসে ১৪ লাখ টাকা পান কাউন্সিলর। এভাবে সাততলা বস্তির অবৈধ গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সংযোগ ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে তার সহযোগী আতর আলী। সেসব অর্থের ভাগ যায় কাউন্সিলরের পকেটে। তার (কাউন্সিলর) সঙ্গে সব সময় সন্ত্রাসীরা ঘোরাফেরা করে। ঠিকাদারি নিয়ে বিরোধে গোলাগুলি-খুনোখুনিতেও রয়েছে তার লোকজন। আরও অনেক কিছু আছে; কিন্তু সব বলা যাবে না।
‘আপনি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ছিনতাইকারী কি খুব মারাত্মক কেউ? তবু তাকে লোকে ভয় পায়। এখন তো ভালো মানুষের মূল্যায়ন হয় না। আর খারাপ লোকজনেরও বিচার হয় না। কে যাবে রিস্ক নিতে?
বনানী থানা যুবদলের এক নেতার কাছে কাউন্সিলরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নিরীহ মানুষ। রাজনীতিতেও তেমন সক্রিয় নই। আমি কোনো ঝুট-ঝামেলায় যেতে চাই না।
চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ, সন্ত্রাসীর সঙ্গে সখ্য :কাউন্সিলরের নাম ব্যবহার করে পুরো ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে তার সহযোগীরা। এলাকার মানুষকে জিম্মি করে বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বস্তির অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে অটোরিকশা, ডিশ-ইন্টারনেট, বর্জ্য বাণিজ্যসহ সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে। সেবা নামমাত্র হলেও মাসিক চাঁদা দিতে হয় ঠিকঠাক। কারণ, তারা কাউন্সিলরের লোক।
অবৈধ কারবারে পারিবারিক সিন্ডিকেট: বিভিন্ন দপ্তরে জমা পড়া লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, মো. নাছির কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার স্ত্রী লতা নাছির, শ্যালক সুন্দরী সুমন, ভাগ্নে ওয়ারীন, ভাতিজা রাশেদসহ তাদের সহযোগী বাহিনী ওয়ার্ডে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। তারা সাততলা ও কড়াইল বস্তিতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জুয়া খেলা, সরকারি জমি দখলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এলাকার ডিশ, ইন্টারনেট ও সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবসাও তারা দখল করেছে।
একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকার সময়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিতুমীর কলেজে ঢুকতে দেয়নি নাছির ওরফে কালা নাছির ও তার বাহিনী। অথচ ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই নাছির হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন মো. নাছির। ২০০১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে দেশে ফেরেন। এরপর তিনি দুই দফায় কাউন্সিলর পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। প্রথম দফায় স্বতন্ত্র ও শেষবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। বর্তমানে তিনি নিজেকে বনানী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন। তবে সেই কমিটি কেন্দ্রের অনুমোদন পায়নি বলে জানা গেছে। একসময় তিনি জাতীয় পার্টি করতেন বলে শোনা গেলেও নাছির তা অস্বীকার করেন। তাকে গোল্ডেন নাছির, আবার ‘কাইল্যা নাছির’ নামেও চেনেন অনেকে।