রাশেদুল ইসলাম: চাঁদপুরের হাইমচরের দক্ষিণ চরভৈরবী এলাকার দিনমজুর অসহায় এক সংখ্যালঘু পরিবারের প্রায় ১৮ একর একত্রিশ শতক জায়গা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করার অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালী দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তরা হলেন, চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখ ও তার আপন চাচাতো ভাই বহু মামলার আসামী বিএনপি নেতা ফজলু শেখ। আর তাদের এই ঘৃণ্য অপকর্মের নেপথ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তাকারী হিসেবে চাঁদপুর উপজেলা প্রশাসন এবং হাইমচর উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন পাটোয়ারীর নাম উঠে এসেছে। জানা যায়, সংখ্যালঘুদের উপর সংঘবদ্ধ এ চক্রটির অত্যাচার নির্যাতনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত গড়িয়েছে।সমস্যা সমাধানে নির্দেশও দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া নির্দেশনার পর কয়েকবছর কেটে গেলেও এখনো ভূমিদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হয়নি অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারটি। সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংখ্যালঘু পরিবারের উপর নির্যাতনের বাস্তব চিত্র পরিলক্ষিত হয়। অপরাধ বিচিত্রার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের নির্মম আর্তনাদের কথা আর ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য। চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার দক্ষিণ চর ভৈরবী এলাকার হতদরিদ্র, অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের সন্তান বিজয় মহাজন।
তিনি জানান, আমার চাচা ভক্তিভূষণ মহাজন এবং আমার বাবা মৃত বিদ্যাভূষণ মহাজন পৈত্রিক সূত্রে দক্ষিণ চর ভৈরবী এলাকায় ১৮ একর ৩১ শতক ভূমির মালিক। ভূমি মালিকানা নিয়ে কোর্টে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় আমার বাবার মৃত্যুবরণ করেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমার চাচা ভক্তি ভূষণ মহাজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখ ও তার চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা ফজলু শেখের নিকট “পাওয়ার অব এ্যাটর্নী” প্রদান করে বলে আমি জানতে পারি।
বিষয়টি জানতে আমি আমার চাচা ভক্তিভূষণ মহাজনের নিকট গেলে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, অস্ত্রের মুখে আমাকে জিম্মি করে উপজেলা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখ ও তার ভাই বিএনপি নেতা ফজলু শেখ এই “পাওয়ার অব এটর্নী নিয়ে নেয়”। জোরপূর্বক পাওয়ার অব এ্যাটর্নী নেওয়ার পর তারা এই কথা কাউকে না বলতে বারণ করে। যদি বলি তাহলে আমাকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে বলে হুমকি দেয়।
এই কারণে আমি ব্যাপারটা গোপন রাখি। ৮০ বছর বয়সী আমার বৃদ্ধ চাচা তাদের হুমকিতে ব্যাপকভাবে ভীত হয়ে পড়েন। ঘটনা জানার পর আমি ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখ ও তার ভাই ফজলু শেখের নিকট এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা দক্ষিণ চর ভৈরবীর আমতলী এলাকার মজিদ খার বাড়ীর সম্মুখে আমার বৃদ্ধা মা ও দুই নাবালক শিশু সহ হাজারো মানুষের সামনে জুতোপেটা ও কানধরে উঠবস করায়।
এসময় দুই নাবালক শিশু বিশ্বজিৎ মহাজন ও নীরব মহাজন আমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলে তাদেরকেও বৈদ্যুতিক তার দিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। সেখানে উপস্থিত লোকজন প্রতিবাদ করতে চাইলে তাদের বাড়িঘরও রাতের আঁধারে পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় কবির শেখ ও ফজলু শেখ। জোরপূর্বক পৈত্রিক ভূমি দখল ও মারধরের ঘটনায় আমি আতংকিত হয়ে পড়ি এবং অপমানে আমার হার্ট এ্যাটাক হয়। এই অবস্থায়ও তারা আমার মাকেও আমার পুরো পরিবারকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মরণাপন্ন:
সুস্থ হয়ে উঠার পর এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিকার পাওয়ার জন্য আমি মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মরণাপন্ন হই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দখলকৃত ভূমি আমার নিকট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য চাঁদপুরের ডিসি মোহাম্মদ মাজেদুর রহমান খানকে ০১/১২/১৮ তারিখে নির্দেশ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশ পাওয়ার পর চাঁদপুরের ডিসি মোহাম্মদ মাজেদুর রহমান খান নিজ কার্যালয়ে ০৩/১২/১৮ তারিখে আমাকে ডেকে পাঠান এবং আশ্বস্ত করেন যে, আমার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের নির্দেশ অমান্য:
দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশ অমান্য করে চাঁদপুরের ডিসি মাজেদুর রহমান ভূমিদস্যু উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখ ও তার ভাই ফজলু শেখ থেকে মোটা অংকের কালো টাকার বিনিময়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করে মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করে। শুধু তাই নয়, চাঁদপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার এবং চাঁদপুরের হাইমচর থানার ওসি রনজিৎ এর নিকট অভিযোগ দিলে তাঁরাও চাঁদপুরের ডিসি মাজেদুর রহমান খানের দেখানো পথ অনুসরণ করে।
প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের দ্বারস্থ হওয়ার পরও ন্যায় বিচার
থেকে বঞ্চিত:
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনার পরও চাঁদপুরের প্রশাসনের নিকট ন্যায় বিচার না পাওয়ায় মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ, পুলিশের আইজিপি, চট্টগ্রামের মাননীয় বিভাগীয় কমিশনার, মাননীয় ভূমিমন্ত্রী, কুমিল্লা র্যাবের (১১) কোম্পানী কমান্ডার সহ প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের দ্বারস্থ হই। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় কোন এক অদৃশ্য “যাদুমন্ত্রের মায়া” বলে সবাই নিশ্চুপ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুতি:
আমি একজন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কেন আমার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত সেইটুকু জানার অধিকারও কি আমি পাবো না ? তাহলে কি “সংখ্যালঘু” তকমা গায়ে মেখে আজীবন নিদারুণ যন্ত্রনায় দিন কাটাবো? এই প্রশ্ন আমার মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।
হাইমচর উপজেলা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখের বক্তব্য:
সংখ্যালঘু বিজয় মহাজনের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে হাইমচর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখ বলেন, “আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সবই মিথ্যা। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ এই ব্যাপারে তদন্তের জন্য চাঁদপুরের জেলা প্রশাসককে বলেছিলেন”।
বিজয় মহাজনকে মারধরের ব্যাপারে তিনি বলেন, “আমি তার গায়ে হাত তুলিনি”। কিন্তু এলাকার লোকজন দেখেছে বলে আবারও জানতে চাইলে, তিনি চুপ হয়ে যায়। বিজয় মহাজনের জায়গা দখলের ব্যাপারেও তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি, বরং এলোমেলো কথা বলতে থাকেন।
বিএনপি নেতা ফজলু শেখের বক্তব্য :
বিজয় মহাজনের অভিযোগের ব্যাপারে ফজলু শেখ বলেন, “ত্রিশ লাখ টাকা প্রদানের মাধ্যমে আমি পাওয়ার অব এ্যাটর্নী নিয়েছি। টাকা কাকে দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাকে দেওয়ার তাকে দিয়েছি। প্রয়োজনে আরো দেবো” কিন্তু জায়গা আমার। কোর্টে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় কিভাবে “পাওয়ার অব এ্যাটর্নী” নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সবই সম্ভব”
এলাকাবাসীর বক্তব্য:
ভাইস চেয়ারম্যান কবির শেখ ও বিএনপি নেতা ফজলু শেখ সম্পর্কে এলাকাবাসীর মনোভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইমচর উপজেলার সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেন “এই দুই ব্যক্তির কারণে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে এলাকার রাজনীতি সহ সামাজিক বন্ধনগুলো। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোকের জায়গা সম্পত্তি তারা দখল করে রেখেছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং পেশী শক্তির প্রভাবের মাধ্যমে।
এলাকাবাসী এদের হাত থেকে বাঁচতে চায়, ফিরে পেতে চায় মৌলিক অধিকার। সংখ্যালঘু বান্ধব বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার দক্ষিণ চর ভৈরবীর এই ঘটনা প্রমাণ করে দেয় সংখ্যালঘুরা আজও কতটা অসহায় স্বাধীন বাংলাদেশে। শীঘ্রই সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সংখ্যালঘু পরিবার তাদের অধিকার ফিরে পাবে এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।