মতিঝিলে টোকাই নুরুর হাতেই কাউন্সিলর মোজাম্মেলের চাঁদাবাজীর রামরাজত্ব

0
1007

স্টাফ রিপোর্টার:
দুর্নীতি দমন কমিশন সহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট অভিযোগ দিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না মতিঝিলের গডফাদারখ্যাত কাউন্সিলর মোজাম্মেল সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজি। অনুপ্রবেশকারীরা আওয়ামী লীগে কোন স্থান পাবে না এমন কথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েক হাজার বারে বললেও ক্যাসিনো খালেদের শিষ্য মতিঝিল এলাকায় এক সময়ের টোকাই, যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম চৌধুরী নুরু ওরফে টোকাই নুরু ঠিকই যুবলীগে স্থান করে নিয়েছেন। যুবলীগের কমিটি হলে নুরু হবেন দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের ৯নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি এমনটা শোনা যাচ্ছে জোড়েশোড়ে। ক্যাসিনো খালেদের হাত ধরে টোকাই নুরু রাজনীতিতে আর্বিভাব, সেই সুবাধে ৯নং ওয়ার্ড যুবদলের সহ-সভাপতি। কিন্তু সময়ে বিবর্তনে খোলস পাল্টিয়ে গুরু-শিষ্য দুজনেই হয়েছেন লেবাসধারী আওয়ামীলীগার। খালেদ-মমিনুল হক সাঈদ-জিকে শামীমদের নিয়ন্ত্রনে মতিঝিলে রামরাজত্ব তৈরি করেন নুরু বাহিনী। ক্যাসিনোকান্ডে খালেদ-মমিনুল হক সাঈদ-জিকে শামীমরা ধসে গেলেও নুরু থেকে যান অধরা। ২০২০ সালের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে মমিনুল হক সাঈদ এর স্ত্রীকে ভোট না দিয়ে, নুরু ভোট দেন দেওয়ানবাগীর ভক্ত মোজাম্মেল হককে। তবে মোজাম্মেলকে কাউন্সিলর বানাতে কোটি টাকা ডোনেট করেন টোকাই নুরু এমনটাই শোনা গেছে ভোটাদের মুখে। কারন একটাই হালুয়া রুটির ভাগাভাগি নিয়ন্ত্রনে রাখা। আর এখন মোজাম্মেলের নিয়ন্ত্রনেই ছুটে চলছে নুরুর অপকর্মের পাগলা ঘোড়া। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়, সরকারী বেসরকারী জায়গা দখল করে দোকান বসিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি ও ভাড়া প্রদান, ময়লা বানিজ্য, নিরাপত্তা বানিজ্য, পানি ও বিদ্যুতের মতো সরকারী সম্পদ চুরি করে বিক্রি, মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টার প্রদান সহ সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েমের মাধ্যমে মাসে কোটি টাকার উপরে চাঁদা আদায় করেন নুরু বাহিনী। তবে এই টাকা নুরু একা ভোগ করতে পারেনা। এই টাকার ভাগ স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় লোকজন সহ নুরুর অধিনস্ত লাইনম্যান থেকে শুরু করে শেল্টারদাতা কাউন্সিলর মোজাম্মেল হয়ে আরো উপর লেভেল পর্যন্ত পৌছায় বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। তবে গুরু-শিষ্য, আওয়ামীলীগ-বিএনপি, যে যাই বলুক না কেন, মুলত টাকা ভাগ বাটোয়ারা হাতিয়ে নিতেই একজন আরেকজনকে দাবারগুটি হিসেবে ব্যবহার করেন মাত্র। কাউন্সিলর সিন্ডিকেটের এসব চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য দুদক চেয়ারম্যান সহ স্বরাষ্টমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের সুত্র ধরে অপরাধ বিচিত্রার অনুসন্ধানে পাওয়া বিচিত্র সব তথ্য নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নুরুর চাঁদাবাজি বন্ধ করার ক্ষমতা কারোই নাই, কারন নুরু চাঁদা একা খায় না, চাঁদার টাকা ভাগবন্টন হয়ে অনেক উপর তলা পর্যন্ত পৌছায়, বছরে কয়েকশ কোটি টাকার উপরে চাঁদা আদায় করে থাকে। ভুক্তভোগিদের এমন প্রতিক্রিয়াই শোনা যাচ্ছে হরহামেশা। নিউজ করে কোন লাভ হবে না। বরং সাংবাদিকরাই উল্টো বিপদে পড়বে। মতিঝিলে যুবলীগের সাইনবোর্ডে টোকাই নুরুর বেপরোয়া চাঁদাবাজী শিরোনামে অপরাধ বিচিত্রায় সংবাদ প্রকাশের পর টোকাই নুরুর চাঁদাবাজী বন্ধের দাবীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট অভিযোগ দায়ের করেছে ভুক্তভোগিরা। তবে সংবাদ প্রকাশের পর চাঁদাবাজির মাত্রা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে নুরু সিন্ডিকেট। আর নুরু সিন্ডিকেটকে পেছন থেকে শেল্টার দিয়ে চাঁদাবাজির কোটি কোটি টাকার ভাগবন্টন বুঝে নিচ্ছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হক। মোজাম্মেল হক কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পরে পুরো ৯নং ওয়ার্ড অর্থাৎ মতিঝিল দিলকুশা আরামবাগ ফকিরাপুল এলাকা এখন টোকাই নুরুর নিয়ন্ত্রনে। কারন হিসেবে শোনা যাচ্ছে মোজাম্মেল হক কাউন্সিলর নির্বাচনের সময় নুরুর নিকট থেকে কোটি টাকা ডোনেট নিয়ে নির্বাচনে খরচ করেছেন। একারনেই মোজাম্মেল হক ৯নং ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রন নুরুর হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

কে এই টোকাই নুরু
ফরিদপুরের ফুলসুতি গ্রামের আব্দুল জলিল বেপারীর ২য় ঘরের সন্তান নুরুল ইসলাম। স্বাধীনতার পরে ৭২/৭৩ সালে ভার্গ্যরে চাকা ঘুরাতে অভাবের সংসার নিয়ে ফরিদপুর ছেড়ে ঢাকা চলে আসেন জলিল বেপারী। বঙ্গভবনের পাশে দিশকুশা বস্তিতে আশ্রয় নিয়ে শুরু করেন জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রাম। গুলিস্তানে তৎকালীন মলম পার্টির গুরু জামাল সেড এর সাথে জড়িয়ে শুরু করেন মানুষকে লুটে নেয়ার কাজ। গুলিস্তানের ছিনতাইকারী চক্র, পকেটে কাটার, অজ্ঞান পার্টি, প্রতারক চক্র সহ নানা অপকর্মের লোকদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধান্ধা চালিয়ে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেন নুরুর বাবা জলিল বেপারী। আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর আগেকার গুলিস্তানের চিত্র যারা নিজের চোখে দেখেছেন তারা কেবল নুরুর বাবার অপকর্ম সম্পর্কে বিশ্বাস করবেন। কারন তৎসময়ে গুলিস্তানে তিন তাসের জুয়া ও কাঠের বক্সের মধ্যে ছোট গর্তে কাচের মার্বেল গুলি ফেলানোর একটি জুয়া খেলার রমরমা বানিজ্য ছিলো। কথিত আছে এই খেলা দুটির জনক ছিলেন নুরুর বাবা জলিল বেপারী। ১০ টাকার বাজিতে এই খেলা দুটি দ্বারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সহজ সরল মানুষকে খাড়ার উপরে বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নেয়া হতো শতশত টাকা। কাঠের বাক্সের নিচের অংশে একটি অদৃশ্য সুতার একমাথা একটি পিনের সাথে আর সুতার অপর মাথা পায়ের আঙ্গুলের সাথে বাধা থাকতো। যখন কেউ ১০ টাকার বাজিতে একটি মার্বেল গুলি বাক্সের গর্তে ফালানোর জন্য ছুড়ে মারতো তখন পায়ের আঙ্গুলের সাহার্য্যে সুতা টান দেয়া হলে কাচের গুলিটি ভিতরের পিনের সাথে লেগে গর্তের অন্য পাশে চলে যেতো। কিন্তু যখন এই বাজিটি জলিলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরতো তখন গুলিটি সরাসরি গর্তের মধ্যে পড়তো। তখন ঐ ব্যক্তিকে ১০ টাকা পরিবর্তে ৩০ টাকা দেয়া হতো, এই লোভে উপস্থিত লোকজন বাজিধরতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। একই ভাবে তিন তাসের খেলায় মধ্যে একটি তাসের উপরে কোন একস্থানে কলমের সাহার্য্যে দেখতে অদৃশ্য একটি চিহ্ন দেয়া থাকতো, নিজেরদের লোকেরাই কেবল ঐ তাসটি চিনতে পারতো। কখনো যদি কেউ এই কৌশল জেনে যেতো তাহলে জলিলের লোকজনেরার তার সাথে মারামারি বাধিয়ে দিতো। এভাবেই জলিল বেপারীর কেরামতিতে চলতো তার অভাবের সংসার। আর অভাবের সংসারে নুরু জীবনে লাগেনি শিক্ষাদিক্ষার আলো। নব্বই দশকে ১৫/১৬ বছর বয়সি নুরু ফুটপাতে চায়ের দোকানে কাজ শুরু করলেও তাতে স্থায়ী হতে পারেনি। ঐ সময় গুলিস্তান এলাকায় হেরোইন নামক মাদকটির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। নুরুও জড়িয়ে পড়েন হেরোইন বিক্রির কাজে। একটানা ৭/৮ বছর হেরোইন বিক্রি করে ভালোই টাকা পয়সা রোজগার করেন, কিন্তু জেল খাটার ভয়ে নব্বই দশকের শেষদিকে নুরু চলে যান মালয়েশিয়াতে। বছর তিনেক মালয়েশিয়াতে অবস্থান করে ৯৯ সালে দেশে চলে আসেন শুন্যহাতে। দেশে এসে শুরু করেন ভাঙ্গারী টোকানোর কাজ। একারনে তার নামকরন হয় টোকাই নুরু। কিন্তু এই ভাঙ্গারী ব্যবসায়ও তার পেট ভরে না। তৎকালীন সময়ে গুলিস্থান-মতিঝিলের বড়ভাই খ্যাত বিএনপি নেতা খালেদ মাহমুদ ভুইয়ার হাতধরে শুরু করেন যুবদলের রাজনীতি। বিএনপির মিছিল মিটিংয়ে লোকজন আনা এবং আওয়ামীলীগের মিছিল মিটিংয়ে হামলা চালানোর গুরুদায়িত্ব ছিলো নুরু হাতে। বিএনপির সরকারের সময় আর্র্থিকভাবে মোটামুটি সফলতার মুখ দেখতে পেলেও সিন্ডিকেটভুক্ত ক্ষমতার ভিত শক্ত করেন ভালোভাবে। তবে ২০০৬ সালে শেষ দিকে ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতায় এলে বছর দুয়েক যে যার মতো গা ঢাকা দিয়ে থাকেন নুরু ও তার বাহিনী সদস্যরা। ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর বাইরে বেরিয়ে আসে নুরু ও তার বড় ভাইয়েরা। শুরু করেন নতুন মিশন। গুরুখ্যাত বড় ভাইদের পথ অনুসরন করেই বিএনপির রাজনীতি ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঢুকে পড়েন আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে। এবার আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নাই। মতিঝিলের ফুটপাত দখল নিয়ে নুরু শুরু করেন চাঁদাবাজি আর বড় ভাই খালেদ মাহমুদ, মমিনুল হক সাইদ ও জিকে শামীমরা শুরু করেন ক্যাসিনো ব্যবসা সহ সরকারী টেন্ডার বানিজ্য। তবে ক্যাসিনোকান্ডে এসব বড়ভাইদের রাজত্বের পতন ঘটলে নুরুর ঠিকানা হয় দেওয়ানবাগীর ভক্ত ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হকের ডেরায়। কোটি টাকা খরচ করে মোজাম্মেলকে কাউন্সিলর বানাতে নুরুর চমক ছিলো অবাক করার মতো। মোজাম্মেলের হাতে মুরিদ হয়ে টোকাই নুরু এখন যুবলীগের সাইনবোর্ডে ফুটপাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজ। তবে এবার চমক হিসেবে নুরু তার নামের পাশে আমদানি করেছেন চৌধুরী পদবী অর্থাৎ নুরু এখন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। বর্তমানে বসবাস করেন কয়েক কোটি টাকা দামের নিজস্ব ফ্লাটে আর চলাফেরা করেন বিলাশবহুল প্রাইভেট গাড়িতে। চোখে থাকে কালো সানগ্লাস। আর হাতের আঙ্গুলে আছে অষ্টধাতুর দরবেশী আংটি। তবে ডিএনএ টেষ্ট করলে পাওয়া যাবে বহুমুখী অপকর্মে কালো দাগ।
মতিঝিলের দিলকুশা বস্তিটি কেউ দেখেছেন?
ইনুছ সেন্টার ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ভবনের মাঝে একটি সরুগলি আছে। গলিরমুখটি পুরনো একটি টিন দ্বারা আটকানো। টিন সরালে একজনের বেশী মানুষ একসাথে ঢুকতে পারবে না। গলি দিয়ে ভিতরে ঢুকলে একটি অবাক দৃশ্য চোখে পড়বে। তবে সুনিদিষ্ট লোকজন ছাড়া ভিতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। ইনুছ সেন্টার ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ভবনের পেছন সাইট থেকে দুইপাশ ধরে আকিজ ভবনের পেছনে ইসলামি ব্যাংকের ভবন পর্যন্ত ভিতরে বিশাল আকৃতির লম্বা একটি জায়গা আছে। এই জায়গায় রয়েছে শতাধিক টিনের ঘুপরি ঘর। এক একটি ঘরে ৮/১০ জনের মতো লোক বাস করে। প্রতি সিটের ভাড়া ১৫শ থেকে ২ হাজারের উপরে। এটাকে প্রাচীন ঢাকা শহরের দিলকুশা বস্তি নামে বয়স্কদের অনেকেই চিনে। এই বস্তিতেই কেটেছে নুরুর শিশু কিশোর বাল্যকাল। তবে এটা এখন নুরুর বস্তি নামেই পরিচিত, যদিও এখানে আগের মতো বস্তির চেহারা খুজে পায় না, কারন অবৈধ বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ সহ আধুনিক যুগের ইন্টারনেটের স্থায়ী সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ব্যাচেলর পুরুষ মানুষের আবাসস্থল এটি। অন্তত ৩ শতাধিক লোক এখানে বসবাস করে। প্রতিজন ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা ভাড়া দিলে প্রতিমাসে গড়পড়তায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার উপরে ভাড়া উঠে। আর এই টাকার একটি বড় অংশ ঢুকে কাউন্সিলর মোজাম্মেল ও নুরুর পকেটে।
ওসি রুমের ডেকোরেশন কেন নুরুর টাকায়
ইদানিং কেউ মতিঝিল থানায় গিয়েছেন, কোন কারনে গেলে একটি দৃশ্য খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করবেন। মতিঝিল থানার ওসির রুমটি খুবই গর্জিয়াস ভাবে ডেকোরেশন করা আছে। প্রশ্ন হলো এই ডেকরেশন করার খরচ এলো কোথা থেকে। উত্তর একটাই নুরুর টাকায় ডেকোরেশন হয়েছে। কিন্তু কেন। লোকে বলে নুরু তার চাঁদাবাজির রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে এর চাইতেও বেশী কিছু করতে প্রস্তুত। নুরুর নামে অভিযোগ হলে কোন প্রতিকার মিলে না। অনেক সময় অভিযোগকারীকেই উল্টো বিপদে পড়তে দেখা গেছে। দীর্ঘদিন ধরেই নুরু মতিঝিল ৯নং ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রন নিয়ে ফুটপাতের চাঁদাবাজি, দখল বানিজ্য, পানি ও বিদ্যুৎ চুরির ব্যবসা মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে। এই বিষয়গুলো সংবাদমাধ্যমে জোড়ালো ভাবে প্রকাশিত হলেও থানা পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি। তবে থানা পুলিশকে জিজ্ঞেস করলে তারা সাবলিল ভাবে উত্তর দেয়-আমাদের কাছে কোন অভিযোগ নেই, তাই ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে কেউ যদি অবৈধ কোন কাজের সাথে যুক্ত থাকে, আর পুলিশকে তা জানানো হয়, তাহলে পুলিশ কি ভূমিকা গ্রহন করে এমন প্রশ্নের কোন উত্তর তখন মিলেনি।

টোকাই নুরুর নিয়ন্ত্রনে ডলার ছিনতাই চক্র:
মতিঝিলের দিলকুশায় সরকার অনুমোদিত কয়েকটি মানিএক্সচেঞ্জ অর্থাৎ ডলার ভাঙ্গানোর অফিস রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রবাসীরা এখানে ডলার ভাঙ্গানোর জন্য আসে। কিন্তু এখানে নুরুর একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা মানিএক্সচেঞ্জ অফিসগুলো আশেপাশে উৎপেতে জড়ো হয়ে থাকে। যখন কোন লোকজন ডলার ভাঙ্গাতে এখানে আসে তখন নুরু লোকজন তাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে বেশী দামে ডলার কেনা প্রস্তাব রাখে। যদি কেউ তাদের প্রলোভনে পড়ে ডলার বের করে নুরু লোকজনের হাতে দেয়া মাত্র নুরুর অন্য লোকজনেরা হৈচৈ বাধিয়ে ভীরের মধ্যে ডলার নিয়ে চম্পট মারে। এই ঘটনা গুলো নুরুর সিন্ডিকেটের লোকেরা প্রতিনিয়তই ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু ভুক্তভোগি কেউ থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ এসে তা উদ্ধারের এমন নাটক করে যা দেখে ঐ অভিযোগকারী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
কাউন্সিল মোজা ও টোকাই নুরুর ময়লা বানিজ্য:
বাসা-বাড়ী/ফ্ল্যাট প্রতি মাসিক ১শ টাকা আর মার্কেটের দোকান প্রতি মাসিক ৩০ টাকা হারে আদায় করার শর্তে দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের কোষাগারে ১২ লাখ টাকা জমা দিয়ে এসডি মিশনের নামে ঠিকাদার মান্নান হাওলাদার ৯নং ওয়ার্ডের বর্জ্য পরিষ্কারের অনুমোদন পায়। কিন্তু কাউন্সিলর মোজাম্মেল হক এই কাজটি নুরুর নামে আনার জন্য জোড় তদ্বির চালায় মেয়র তাপস সাহেবের কার্যালয়ে। কিন্তু টোকাই নুরু বিএনপি থেকে যুবলীগে অনুপ্রবেশকারী হওয়া কাউন্সিলরের সেই চেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। অত:পর কৌশল পরিবর্তন করে মোজাম্মেল ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে মান্নানের নিকট থেকে নুরু, খোকন ও সালাউদ্দিন রতনের কাছে এটাকে সাব-ক্রয় করায়। বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগে অনুপ্রবেশকারী এই খোকনের নাম ১০%, বিএনপি সর্মথক রতন মেটালের মালিক সালাউদ্দিন রতনের নামে ১০% এবং বাকী ৮০% থাকে নুরু ও মোজাম্মেলের নিয়ন্ত্রনে। যদিও বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ যেই ঠিকাদার পাবে, তাকেই সেই কাজ করতে হবে, তানাহলে চুক্তি বাতিল বলে গন্য হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বর্জ্য বানিজ্য থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আদায় করা হবে বলেই কাউন্সিলর মোজাম্মেল এটা হাত ছাড়া করেননি। কারন ৯নং ওয়ার্ডে সব মিলিয়ে ২০ হাজারের অধিক পরিবার বা পয়েন্টে রয়েছে। যারা কমপক্ষে ১শ টাকার বিনিময়ে তা নুরু বাহিনীর মাধ্যমে তাদের বর্জ্য-ময়লা পরিষ্কার করে থাকেন। সুতরাং এই খাত থেকে নুর বাহিনী সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র জোড়জবস্তি, দাঙ্গা-হাঙ্গমা চালিয়ে বছরে অন্তত সাড়ে ৩ কোটি টাকা উপরে আদায় করবে। আর এই জন্যই বর্জ্যরে ঠিকাদারী হাত ছাড়া হয়ে গেলে যে কোন কাউন্সিলরেরই রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। কারন ফ্ল্যাট প্রতি বর্জ্যরে রেট ১শ থেকে ৫শ আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রেট ৫শ থেকে ১হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন আবার নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। ৯নং ওয়ার্ডের জুড়ে ফুটপাতে অন্তত ১৫ হাজার মতো হকারের দোকান রয়েছে। প্রতি দোকান থেকে বর্জ্য বিল বাবদ আদায় করা হচ্ছে দৈনিক ২০ টাকা হারে। কিন্তু এই ২০ টাকার জন্য কোন রশিদ দেয়া হয় না। জানতে চাইলে নুরুর লোকেরা বলেন, তারা সিটি কর্পোরেশন থেকে বর্জ্য পরিষ্কারের টেন্ডার পেয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জিজ্ঞেস করলে জানায়, বর্জ্যব্যবস্থাপনার নামে ফুটপাত থেকে টাকা উঠানোর কোন টেন্ডার হয় নাই।

ফুটপাতে চাঁদাবাজী:
মতিঝিল ৯নং ওয়ার্ড এলাকার রাস্তা দখল করে চায়ের দোকান, ফলের দোকান, কাপড়ের দোকান, শাকসব্জির দোকান, আল-সালাদিয়া হোটেল সহ হরেক রকমের অন্তত ১৫ হাজারের উপরে ক্ষুদ্র দোকান ব্যবসায়ী রয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক বিদ্যুৎ বিল, বর্জ্য বিল, নেতা বিল, পুলিশ বিল সব মিলিয়ে দৈনিক গড়ে অন্তত ৩শ টাকা হারে বছরে ১৫০ কোটি টাকার উপরে চাঁদা আদায় করা হয়ে থাকে নুরু বাহিনী। ফুটপাতের প্রতি দোকান বাবদ নুরুর লাইনম্যান আদায় করে আড়াইশ টাকা।এই টাকা থেকে স্থানীয় পুলিশের জন্য দেড়শ টাকা আর ১শ টাকা নুরু ও কাউন্সিলর মোজম্মেলের মধ্যে ভাগভাগি হয়ে থাকে।

ওয়াসার পানি চুরি ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে টাকা আদায় :
টোকাই নুরু বিদ্যুতের খুটি থেকে ফুটপাতের দোকানে সরাসরি বিদ্যুতের চোরাই লাইন সংয়োগ দিয়ে বিল বাবদ ৪০ টাকা হারে দৈনিক আদায় করে থাকে। এই টাকার একটি অংশ নুরুর হাত ধরে চলে যায় স্থানীয় বিদ্যুত অফিসের কর্মকর্তাদের পকেটে। একই ভাবে ওয়াসার পানি চোরাই পথে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আদায় করে ওয়াসার কর্মকর্তাদেরও মাসোয়ারা দিয়ে ম্যানেজ করে থাকে। সুত্র জানায়, রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা দিলকুশায় প্রকাশ্যে ওয়াসার লাইনে পাম্প লাগিয়ে পানি বোতলজার, ড্রাম ও গ্যালন ভর্তি করে হোটেল, রেঁস্তোরা, অফিস, আদালত, বাণিজ্যিক অফিস ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে নগদ দামে বিক্রি করে আসছে টোকাই নুরু। এটি এখন নুরুর পাম্প নামে পরিচিত হয়ে গেছে। টিভিতে এই সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার পর ওয়াসা তাৎক্ষনিক অভিযান পরিচালনা করে লাইন কেটে দিয়ে ছিলো। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার কয়েক অসাধু কর্মকর্তা সহ কাউন্সিলর মোজাম্মেলের শেল্টারে নুরু এখন ডবল পাইপ লাগিয়ে পানি বিক্রি করে আসছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুতের বিল উত্তোলনকারী এক লাইনম্যান বলেন, ফুটপাতের দোকান গুলোতে বিদ্যুতের খুটি থেকে চোরাই পথে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে প্রতি লাইট বাবদ প্রতিদিন ৫০-৬০ টাকা হারে আদায় করা হয়, যদি কেউ লাইট না জ্বালায় তাহলে তাকেও টাকা দিতে হয়। এটাই নুরু ভাইয়ের নিয়ম।

টোকাই নুরুর অবৈধ দখল বানিজ্য:
পূর্বানী হোটেলের পিছনের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে অন্তত ৩০টি দোকান ঘর নির্মান করে ভাড়া দিয়ে রেখেছে নুরু প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার উপরে ভাড়া আদায় করে থাকে। এই জায়গায় রাব্বানী হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট নামে একটি স্থায়ী স্থাপনা নির্মান করে খাবারের হোটেল বানিয়ে মাসিক আড়াই লাখ টাকায় ভাড়া দিয়ে রেখেছে। একটি সুত্রে জানা গেছে এই হোটেল মালিকের থেকে নুরু ২০ লাখ টাকা এডভান্স নিয়েছে।

কাউন্সিলর মোজাম্মেলের নতুন চাঁদা:
কাউন্সিলর মোজাম্মেলের রাজত্বে এক ধরনের নতুন চাঁদার আর্বিভাব ঘটেছে, এই চাঁদার নাম নিরপত্তা চাঁদা। অর্থাৎ ওয়ার্ডবাসীকে পাহারাদারের মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রদান করা। ৯নং ওয়ার্ডের ফকিরাপুল এলাকায় নুরুর ক্যাডার লিক্সন এই চাঁদা আদায় করে থাকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ২শ টাকা আর বাসাবাড়ীর প্রতি রুম থেকে ১শ টাকা হারে এই চাঁদা আদায় করা হয়।

কাউন্সিলরে মোজাম্মেলের চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের দুই সদস্য গ্রেপ্তার:
চাহিদা মত চাঁদার টাকা না দেয়ায় ১৫ আক্টোবর-২০২০ আরামবাগ কালভার্ট রোডের পুরানো কাগজ ও ছাঁট ব্যবসায়ী মো: সালাম খানকে প্রকাশ্যেই মারধর করে কাউন্সিলর মোজাম্মেল চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের সদস্য এ আর আবদুস সালাম ও তার সহযোগী মো: খালেক, সোহাগ ও নিজাম। ব্যবসায়ী সালাম খান প্রতিকার চেয়ে কাউন্সিলর মো: মোজাম্মেল হকের কাছে নালিশ করেন। কিন্তু কাউন্সিলর মোজা তা আমলে না নেয়ায় ঐ ব্যবসায়ী মতিঝিল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে ১৯অক্টোবর-২০২০ বাদী সালাম খানের অভিযোগটি আমলে নিয়ে সালাম ও খালেক গ্রেপ্তার করে কোর্টে চালান দেন। মামলা নং-৩০। কিন্তু এসব চাঁদাবাজদের পক্ষে কাউন্সিলর মোজাম্মেল বলেন, ছেলেগুলো (গ্রেপ্তারকৃত সালাম ও খালেক) খুবই ভালো মানুষ। কাজ করে ভাত খায়।’ ওসি সাহেব ওদেরকে কথা বলার জন্য থানায় নিয়ে গ্রেফতার করেছেন। সুত্র জানা যায়, আরামবাগ-ফকিরাপুল-দিলকুশা নিয়ে ডিএসসিসির ৯নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর মোজাম্মেল হকের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজিতে লিপ্ত টোকাই নুরুর সিন্ডিকেট। আর সিন্ডিকেটের এক অন্যতম সদস্য এ আর আবদুস সালাম গং। ২০২০সালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিজয়ী হয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন কাউন্সিলর মোজাম্মের হক।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, নুরু যুবদল থেকে যুবলীগের নেতা হওয়ার পরই তার ভাই পুতুলের মাধ্যমে পুরো মতিঝিল এলাকায় ইয়াবা অর্থাৎ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। মাদক ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে বছরে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে সিন্ডিকেটের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে থাকেন।

আর চাঁদা আদায়ের জন্য নুরু রয়েছে একটি লাইনম্যান বাহিনী। দৈনিক বাংলা থেকে মোহামেডান ক্লাব পর্যন্ত লাইনম্যান নুর ইসলাম, টয়োটা বিল্ডিং থেকে বাংলাবানী পর্যন্ত হেলাল, হোটেল পূবানী থেকে অগ্রনী ব্যাংক ভবন পর্যন্ত পবন চন্দ্র দাস ও রঞ্জিত, ইউনুছ সেন্টার থেকে বঙ্গভবন গেইট পর্যন্ত তাজু, অগ্রনী ব্যাংক থেকে সোনালী ব্যাংক চক্রাকারে আমির হোসেন প্রতিদিন এই চাঁদা আদায় করে থাকে। আর এই চাঁদার ভাগ কালেকশনকারী লাইনম্যান থেকে শুরু করে নুরুর হাত ধরে কাউন্সিলর মোজাম্মেল সহ আরো অনেক বড়বড় নেতার পকেটে পর্যন্ত চলে যায়। তবে স্থানীয় থানা পুলিশকেও একটি নিদিষ্ট অংশ দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়। ভাগের টাকা না পেলেই পুলিশ মাঝে মাঝে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। লাইনম্যানরা বলেন, দৈনিক কালেকশন দৈনিক নুরু ভাইয়ের কাছে জমা দিলে আমাদেরকে একটি হাজিরা দেয়া হয়।

এদিকে, মতিঝিল ক্যাসিনো ক্লাবপাড়ায় রাস্তা দখল করা আল-সালাদিয়া হোটেলের মালিক সিয়াম রানা বলেন, প্রতিদিন নুরু ভাইকে বিদ্যুতের চোরাই লাইন থেকে দেয়া বিদ্যুতের জন্য ১৫০ টাকা, ময়লা ফালানোর জন্য ২০০ টাকা, পুলিশের জন্য ২০০ টাকা, নেতার বিল ২০০ টাকা হারে মোট ৭৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। দোকান চালু থাকুক বা বন্ধ থাকুক, প্রতিদিনই এই চাঁদা দিতে হয়। টাকা না দিলে মতিঝিল এলাকায় দোকান করা যাবে না। চলবে.

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × one =