বঙ্গোপসাগরে ট্রলারে বিস্ফোরণ,লক্ষ্মীপুরের রামগতির অগ্নিদগ্ধ ১২ জেলের ৬ জনের মৃত্যু

0
677

এস এম আওলাদ হোসেন: বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার এলাকায় একটি মাছ ধরার ট্রলারে রহস্যজনক বিষ্ফোরণে ২১ জেলে আহত হয়। এতে অগ্নিদগ্ধ ১২ জেলের ৬ জন মারা গেছেন। বাকি ৬ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। মারা যাওয়া ও চিকিৎসাধীন জেলেদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরগাজী ও চররমিজ ইউনিয়নে। দগ্ধ জেলেদের মৃত্যুতে স্থানীয় মানুষের মাঝে চাপাকান্না চলছে। অসহায় হয়ে পড়েছেন জেলে পরিবারগুলো। জানা গেছে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার এলাকায় মাছ ধরা অবস্থায় ট্রলারে রহস্যজনক এক বিষ্ফোরণ ঘটে। ১২ জন অগ্নিদগ্ধসহ ট্রলারে থাকা ২১ জেলের সবাই আহত হয়। অগ্নিদগ্ধ আহত ৬ জন ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। স্বজন ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের শরীরের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই পুড়ে গেছে । মৃত জেলেরা হলেন রামগতির চরগাজী ইউনিয়নের দক্ষিণ টুমচর গ্রামের বেলাল হোসেন (২৮), মো. মেহেরাজ (২৬), চর লক্ষ্মী গ্রামের মো. মিলন (৩০), চররমিজ ইউনিয়নের চর গোসাই গ্রামের আবুল কাশেম (৫৫) ও মো. রিপন মাঝি (৩৮)। বুধবার (১০ মার্চ) বিকেল সোয়া ৩ টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. মেহেরাজ উদ্দিন নামে আরেকজন মারা গেছেন।

ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন চরলক্ষ্মী গ্রামের মো. আলাউদ্দিন, মো. সাহাবউদ্দিন, আবু জাহের, মো. মিরাজ উদ্দিন ও মো. মিরাজ। এছাড়া চরলক্ষ্মী গ্রামের আবদুর জাহেরর ছেলে মেহেরাজ আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাড়িতেই রয়েছেন।

আবদুর জাহেরের আরেক ছেলে মিলন ওই ঘটনায় হাসপাতাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এছাড়া এ ঘটনায় আরো ৯ জেলে আহত হয়ে কক্সবাজারের চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে বাড়িতে ও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

বিস্ফোরণে আহত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসা চরলক্ষ্মী গ্রামের মো. শরীফের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘনায় মাছ ধরা নিষেধ। এজন্য তারা ২১ জন জেলে কক্সবাজারে যায়। সেখানে গিয়ে সোহেল কোম্পানী নামের এক ব্যক্তির এফবি ওশিন নামের একটি ট্রলার নিয়ে তারা সাগরে মাছ ধরতে যায়। ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে তারা ট্রলার চালিয়েছে। অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারা সাগরে জাল ফেলে।

মধ্যরাতে তাদের ট্রলারে হঠাৎ একটি শব্দ করে। পরপর আরো দুটি শব্দ হয়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে তাদের কয়েকজন সাগরে পড়ে যায়। আর কয়েকজন কেবিনে এলোপাতাড়ি পড়ে থাকে। ট্রলারে থাকা একজন সাগরে পড়ে যাওয়াদের সাগর থেকে রশি দিয়ে উদ্ধার করে।

যারা ট্রলারে ছিলো তারা সবাই দগ্ধ হয়ে পড়েছিল। যন্ত্রণায় তারা হাউমাউ করে চিৎকার দিতে থাকেন। ঘন্টাখানিক পর অন্য একটি মাছ ধরার ট্রলার গিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে ৩ ঘন্টা পর নেটওয়ার্ক এলাকায় নিয়ে আসে। পরে তারা ট্রলার মালিক সোহেলকে ফোন করে ঘটনাটি জানায়। তখন তিনি স্পীডবোট পাঠিয়ে তাদের ট্রলার কক্সবাজার নিয়ে আসে।

এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে অগ্নিদগ্ধ ১২ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরাও তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।

কিন্তু আহতরা সবাই টাকার অভাবে বাড়িতে ফিরে আসে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন নিয়ে’ তাদের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসে। গত ২ মার্চ ১২ জেলেকে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়। পাশাপাশি রোগীদের সেবায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত, 

চিকিৎসা ও খরচের অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সংগঠনটি। এর মধ্যে গত শুক্রবার রাতে ২ জন, শনিবার ১জন, সোমবার ১জন, মঙ্গলবার ১জন ও বুধবার ১ জন মারা যান।

আহত শরীফ বলেন, আমরা ভেবেছিলাম ইঞ্জিনে বিস্ফোরণ হয়েছে। পরে দেখলাম ইঞ্জিনের কিছুই হয়নি। গ্যাস সিলিন্ডারগুলোও ঠিক ছিল। ট্রলারও ঠিক ছিলে। বিস্ফোরণের পুরো ঘটনাটিই রহস্যজনক মনে হয়েছে। ওই বিকট শব্দ কিসের ছিল তা আমরা বুঝতে পারছি না। আমাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর ট্রলার মালিক সোহেল তাদের কোন খোঁজ নেয়নি।

‘স্বপ্ন নিয়ে’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, অর্থাভাবে অগ্নিদগ্ধ জেলেদের চিকিৎসা হচ্ছিলো না। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ জন মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। মারা যাওয়া জেলে, চিকিৎসাধীনদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানের জন্য লক্ষ্মীপুরসহ দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি।

চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাওহীদুল ইসলাম সুমন বলেন, আমি ঢাকা হাসপাতালেই আছি। ব্যক্তিগতভাবে নিহত ও আহতদের চিকিৎসাসহ পরিবারকে সহযোগীতা করা হয়েছে। ইউএনওকে বিষয়টি জানিয়েছি। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে আর্থিক সহযোগীতা ও খাবারের ব্যবস্থা করা  হচ্ছে। তবে অগ্নিদগ্ধদের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক।

এ ব্যাপারে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল মোমিন জানান, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আহতদের চিকিৎসাসহ নিহতদের পরিবারকে সহযোগীতা করা হবে। তবে বিস্ফোরণের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনকে কক্সবাজার সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরামর্শ দিচ্ছি। কি কারণে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে তখন তদন্তের মাধ্যমে উঠে আসবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fifteen + three =