Site icon Aparadh Bichitra

গফফার মুন্সী মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়

পটুয়াখালী উপকুলীয় প্রতিনিধি: আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী। আর এই সুবর্ন জয়ন্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংশোধিত পুর্নাঙ্গ তালিকা প্রকাশের কথা শোনা যাচ্ছে। এ তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে পাবে তাদের হারানো সম্মান। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় নাম না দেখে চাপা কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিবেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী অনেকেই রয়েছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তালিকায় নাম অর্ন্তভূক্ত করাতে পারেনি। স্বাক্ষী প্রমান থাকলেও তালিকা প্রননয়নকারীদের বিশেষ চাহিদা মেটাতে না পারায় বাদ পরেছেন। এমনই একজন মুক্তিযোদ্ধা মহিপুর থানা সদরের নজীবপুর গ্রামের মৃত ইসমাইল মুন্সীর পুত্র আঃ গফফার মুন্সী (৭০)। রাজাকার সেরাজ কমান্ডের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবার অপরাধে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে বন্দি হয়ে জেলে যান তিনি। জেলে থাকার কারনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও তার অবদান কম নয়। দেশের জন্য জেল খেটেছেন। হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। ছেলের শোকে মা মুত্যু বরণ করে। মায়ের লাশ পর্যন্ত দেখতে দেয়া হয়নি। গফফার মুন্সী মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার  নাম অর্ন্তভূক্ত করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে গফফার মুন্সীর দাবী ভাতা চাই না চাই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। 

জানা গেছে, মহিপুর কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর ছাত্র আঃ গফফার মুন্সী। তখন বয়স ১৮ বা ১৯। এমন সময়ে রেডিওতে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনতে পান। কিশোর আঃ গফফার মুন্সী বঙ্গবন্ধুর ভাষনে উজ্জিবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবারের অজান্তেই মেজর হাতেম আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তৎকালীন কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের গোড়া আমখোলা পাড়ার রাখাইনদের সেচ্ছায় দান কৃত ৭টি বন্ধুক নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। প্রথমেই খাপড়াভাঙ্গা ইউনিয়নের শান্তি কমিটির ইউনয়ন লিডার সেরাজ কমান্ডারের সেরাজপুর গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয় গফফার মুন্সীর নেতৃত্বে। এর দুইদিন পর মেজর হাতেম আলীর নেতৃত্বে বরগুনা জেলার বামনা থানার বুকাবুনিয়া গ্রামে প্রশিক্ষনে যাবার জন্য রওয়ানা হয়ে যান। পথিমধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে বন্দি হয় গফফার মুন্সী,আনিসুর রহমানসহ ৫ মুক্তিযোদ্ধা। সেনাদের হাতে বন্দি ৫ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যাওয়া হয় কলাপাড়া থানায়। সেখানে নির্যাতনের পর অন্য সকলকে ছেড়ে দেয়া হলেও গফফার মুন্সীকে নিয়ে যাওয়া হয় পটুয়াখালী সার্কিট হাউজে। সেখানে পাকিস্তানি মেজর নাদের পারভেজ এর নির্দেশে অমানষিক নির্যাতন শেষে পটুয়াখালী জেলে নেয়া হয়। জেলে যাবার কিছুদিন পর মা মারা যয়। কিশোর আঃ গফফার মুন্সীকে মায়ের লাশ পর্যন্ত দেখতে দেয়া হয়নি। এর প্রায় দুই মাস পর ভারতীয় সেনাবাহিনী পটুয়াখালী জেলের মধ্যে উড়োজাহাজ থেকে বোমা বর্ষণ করে। এসময় জেলে অন্যান্য বন্দীদের সাথে গফফার মুন্সীও পালিয়ে বাড়িতে আসেন। ওইদিনই পাকিস্তানী সেনাদের হাত থেকে মুক্ত হয় কলাপাড়া থানা। পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘৃনা এবং ভয়ে আঃ গফফার মুন্সী আত্মগোপণে চলে যায়। যদি রাজাকাররা বঙ্গবন্ধুর মত মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলে এমন আশংকা থেকেই আত্মগোপনে চলে যান তিনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রননয়ন করা হয়। ওই তালিকায় তার নাম না থাকায় আবেদন করেন তিনি। যার সিরিয়াল নং ৬৮/ ডিজি নং ১৭৩৯। এরপর উপজেলা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে একাধিকবার যোগাযোগ করেও রহস্যজনক কারনে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম অর্ন্তভূক্ত করাতে পারেননি।

আঃ গফফার মুন্সী ক্ষোভ ও ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন এমন একাধিক স্বাক্ষি প্রমান থাকা সত্বেও তালিকা প্রননয়নকারীদের বিশেষ চাহিদা পুরন করতে না পারায় তার নাম তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়নি। তিনি বলেন,তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সাবেক এমপি আব্দুর রাজ্জাক খান, আঃ ছত্তার মুন্সী,মোঃ ফজলুল হক, পল্লী চিকিৎসক অনিল চন্দ্র দাস বেচে নেই। তবে রাজাকারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধারা এখনও বেচে আছেন। তারা জানেন কিন্ত স্বীকৃতি দিচ্ছে না। গফফার মুন্সী দাবী করেন, সরেজমিনে তদন্ত করলে সত্যতা বেড়িয়ে আসবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ভাতা চান না,মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চান। 

এবিষয়ে তৎকালীন লতাচাপলী ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সদস্য আঃ খালেক খলিফা বলেন, গফফার মুন্সী প্রকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার নেতৃত্বে সেরাজ কমান্ডের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জালিয়ে দেয়া হয়। এ অপরাধে তাকে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে বন্দি হতে হয়। আমি এর প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। তিনি আরও বলেন, গফফার মুন্সীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসবে স্বীকৃতি না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আঃ ছত্তার ফরাজী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে স্বীকার করে বলেন,   গফফার মুন্সী একজন মুক্তিযোদ্ধা আমরাও তা জানি। কিন্ত স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। আগামী ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ হবার কথা শোনা যাচ্ছে। এখন আর তার নাম তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, অবহেলার কারনে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্বেও তার নাম তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করাতে পারেনি এটা তার নিজেরই ব্যর্থতা।