২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে উদ্ভূত নভেল করোনাভাইরাস এক মাসের ব্যবধানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় শতবর্ষ আগের স্প্যানিশ ফ্লুর পর করোনাভাইরাসই সারা বিশ্বে সবচেয়ে মারাত্মক মহামারী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নানা প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও সতর্কতার পরও এ ভাইরাসের প্রকোপ সন্তোষজনক পর্যায়ে কমছে না; বরং কোনো কোনো দেশে নতুন নতুন রূপ ও ধরন নিয়ে বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে কঠিন আঘাতপ্রাপ্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোতে আগের তুলনায় করোনাভাইরাস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও বাংলাদেশসহ এশিয়ার কিছু দেশে এটি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশেষত বাংলাদেশে এ মহামারী ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।কয়েক মাস ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যখন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে, তখনই আঁচ করা গিয়েছিল বাংলাদেশেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট কভিড-১৯ ব্যাপক আঘাত হানতে পারে। কারণ দেশের তিন দিকেই আমাদের সঙ্গে ভারতের সীমানা। ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে উভয় দেশে যাতায়াত অবশ্যম্ভাবী। বলতে গেলে বাংলাদেশে মহামারীর তৃতীয় ঢেউ চলছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় এখনকার অবস্থা মারাত্মক। প্রতিদিনই মৃত্যু অথবা আক্রান্তের সংখ্যা আগের রেকর্ড ভঙ্গ করছে। মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ অতিক্রম করেছিল। তৃতীয় ঢেউয়ে এ সংখ্যা ২০০ অতিক্রম করেছে।
১২ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৭ ও মোট মৃত্যু ১৬ হাজার ৬৩৯ জন। রোগ শনাক্তের হার ৩১ শতাংশ। ১১ জুলাই থেকে ১২ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৬৮ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২২০ জন। ১০ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ১১ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত মারা যায় এক দিনের রেকর্ড ২৩০ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে শনাক্তের হার ও মৃত্যু আরো বাড়বে, কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কারো জানা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মর্মে ধরা হয়। সে বিবেচনায় দেশে করোনা অতিমারীর অবস্থা ভয়াবহ।
আগে গ্রামে করোনা তেমন একটা ছিল না। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর মফস্বল শহর ও গ্রামেও এ রোগ ছড়িয়ে গেছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। আরো একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে আক্রান্ত রোগীদের সবাই হাসপাতালে এসে করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আবার উপসর্গ নিয়ে অনেকেই জেলা ও থানা হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে এসে মৃত্যুবরণ করছেন। সেগুলো সরকারি হিসাবে আসে না, সেজন্য অনেকের মতে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
সাম্প্রতিককালে রোগের প্রকোপ বাড়ায় হাসপাতালগুলোয় রোগীর চাপ বাড়ছে। ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতেও অক্সিজেনস্বল্পতায় অনেক রোগী কষ্ট করছে, কিংবা অনেকে মারা যাচ্ছে। দেশে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৭১৪। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ১ হাজার ৫৯টি। ভেন্টিলেটর ও আইসিইউর সংখ্যাও সীমিত, অর্থাৎ বর্তমান প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
দেশের হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ভয়ভীতির কারণে করোনা রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থায় কিছুটা অবহেলা ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেটি নেই। জীবন বাজি রেখে অনেক ডাক্তার চিকিৎসা দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত ১৫০-এরও অধিকসংখ্যক ডাক্তার মারা গিয়েছেন।
করোনা অতিমারী মোকাবেলায় সরকারি সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই। পর্যায়ক্রমে ছুটি, লকডাউন ও নানা বিধিনিষেধ জারি করা হচ্ছে। নানা স্থানে জরুরি অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন ও চালু হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতকরণ এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন উৎস থেকে করোনা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে টিকা দেয়া হচ্ছে।
কলকারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু থাকলেও হোটেল-রেস্তোরাঁ, শপিং মল ও গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। শুধু দৈনন্দিন কাঁচাবাজার ও ওষুধের দোকান শর্তসাপেক্ষে খোলা রয়েছে। এ রোগ থেকে বেঁচে থাকার প্রধান উপায় হচ্ছে ঘরে থাকা, বাইরে মেলামেশা না করা, প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধোয়া বা নিয়মিত স্যানিটাইজ করা। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ বিধিনিষেধের আওতায় থাকতে চায় না। লকডাউন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনীর তত্পরতায়ও মানুষকে বাইরে যাতায়াত ও ঘোরাঘুরি থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না।
সরকারের করোনা মোকাবেলায় কিছু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাও রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয় ও সংগ্রহ, ভ্যাকসিন সংগ্রহ ইত্যাদিতে দীর্ঘসূত্রতার ও অদক্ষতার খরব শোনা যায়। ক্রয় ও সরবরাহ কাজে পুরনো সিন্ডিকেটগুলো এখনো সক্রিয় রয়েছে।
যেভাবে আক্রান্তের হার বাড়ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে রেকর্ড সংখ্যক, সেটি মোকাবেলার জন্য দেশপ্রেম ও সততা নিয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের সময়োচিত সিদ্ধান্ত বাস্তবমুখী ও প্রশংসনীয়। কলকারখানা সচল রাখার কারণে উৎপাদন, সরবরাহ চেইন ও কর্মসংস্থান চালু রয়েছে। তবে অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা ও কাজকর্ম বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যারা বেকার হয়ে দারিদ্র্যে নিপতিত হয়েছে, তাদের কীভাবে নগদ সহায়তার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা যায় সে উপায় বের করা প্রয়োজন।
গত জুন সমাপ্ত অর্থবছরের দেশজ উৎপাদন, সাপ্লাই চেইন, রফতানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রভৃতিতে ইতিবাচক ও সন্তোষজনক অবস্থা বিরাজ করলেও করোনা মহামারীর বর্তমান তৃতীয় ঢেউ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে না পারলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সেজন্য সরকার ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে করোনা মোকাবেলায় ভূমিকা পালন করতে হবে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সংক্রমণের হার না কমলে শিগগিরই হাসপাতালগুলোতে বেড সংকট হবে, অর্থাৎ চিকিৎসা না দিয়ে রোগী ফেরত দিতে হবে। টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, একজন চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, রোগী বা তার স্বজনরা এখন অপেক্ষা করে কখন একজন রোগী মারা যাবে, তারপর তাদের রোগী একটি আইসিইউ বেড বা অক্সিজেন পাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস মোকাবেলার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো (১) ঘরে থাকা ও জনসমাগম এড়িয়ে চলা, (২) বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে স্বাস্থ্যসম্মত নিয়ম মেনে মাস্ক পরিধান করা। যেনতেনভাবে মাস্ক ব্যবহার চলবে না, (৩) নিয়মিত হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করা, (৪) নাক-মুখে হাত দেয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করা, সর্বোপরি (৫) দুই ডোজ টিকা নেয়া।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো এ পর্যন্ত ৫০-৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভ্যাকসিনেশন সুবিধা তেমনভাবে পাওয়া যায়নি। টিকা সংগ্রহে আমাদের তত্পরতা আরো বাড়াতে হবে এবং বয়স নির্বিশেষে জনগণকে টিকার আওতায় আনার চেষ্টা করতে হবে। ডব্লিউএইচও অনুমোদিত এবং বিভিন্ন দেশে স্বীকৃত ও পরীক্ষিত ভ্যাকসিন সংগ্রহে জোর দিতে হবে। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির পাশাপাশি মানসম্পন্ন টিকা ক্রয়ে কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদার করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের জনসংখ্যার তুলনায় বর্তমানে ভ্যাকসিন মজুদ ও সরবরাহ এখনো সন্তোষজনক নয়।
দেশে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়— আমাদের অনেক ইতিবাচক প্রচেষ্টা ও অর্জনকেও বিরূপ সমালোচনা করে উড়িয়ে দেয়া হয়। আবার আমরা যা পারি না তা স্বীকার করি না। দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। শুধু সমালোচনা না করে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য দেশের সব মিডিয়া, সুশীল সমাজ, রাজনীতিক প্রমুখের ইতিবাচক ভূমিকার বিকল্প নেই।