পটুয়াখালী গলাচিপার ভূমিদস্যু শিহাব পর্ব-৪

0
420

রাশেদুল ইসলাম: ভ‚মিহীন হয়ে ভেসে বেড়ানো পরিবারগুলোর একমাত্র অবলম্বন সরকারি বন্দোবস্তকৃত জমি। ভ‚মিহীন পরিবারের দু:খ-দুর্দশা দেখার কেউ না থাকলেও সরকারের দেয়া এসব জমিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সোনার ফসল ফলিয়ে কিছুটা বাঁচার স্বপ্ন দেখে তারা। তবে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতোই অসহায় এসব পরিবারের বাঁচার শেষ স্বপ্নটুকু কেড়ে নিতে সবসময় ওঁৎ পেতে মানুষরূপী এক শ্রেণীর হিংস্র জানোয়ার। ‘অপরাধ বিচিত্রা’ দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে স¤প্রতি পটুয়াখালীর গলাচিপার আমখোলা মৌজার চিংগুড়িয়াতে প্রায় দেড় শতাধিক অসহায় ভ‚মিহীনদের কান্নার আহাজারি বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিল। যেখানে উঠে এসেছে শিহাবসহ বেশ কয়েকজন রাঘববোয়াল ভ‚মিদস্যুদের নাম। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মো: মতিউল ইসলাম চৌধুরীর সাথে দেখা করেন ভুক্তভোগী ভ‚মিহীন কৃষক আব্দুল মান্নান। পুরো অভিযোগের কথা শুনে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে অভিযোগের দরখাস্তে গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন তিনি। জেলার সর্বোচ্চ কর্তার নির্দেশ পাওয়ার পর ইউএনও বিষয়টির দায়িত্ব দেন সহকারি ভ‚মি কমিশনার নজরুল ইসলামকে।তিনি সরেজমিনে সরকারি বন্দোবস্তকৃত চিংগুড়িয়া চরের সেই জমিগুলো পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে ভেকু মেশিন দিয়ে সরকারি জমিতে মাটি কাটতে দেখেন তিনি। সংশ্লিষ্ট কাউকে ঘটনাস্থলে না পাওয়ায় ভেকু মেশিন জমি থেকে সরিয়ে দেন তিনি। কিন্তু তবুও দমে যায় নি ভ‚মিদস্যুরা। রাতের আঁধারে জমির পাশে রাস্তা নির্মানের চেষ্টা করা হলে ইউএনওকে খবর দেয় ভ‚মিহীন ভুক্তভোগীরা। ইউএনও’র কড়া নির্দেশে বন্ধ হয় সেই কাজ। পরবর্তীতে আবারও সহকারি ভ‚মি কমিশনার নজরুল ইসলাম তদন্তে যান সেই জমিতে। সে সময় সরকারি বন্দোবস্তকৃত ও রিসিভারের জমি থেকে ট্রলি মেশিন এবং বিপুল পরিমাণ ধান জব্দ করা হয়। আর ভেঙ্গে দেয়া হয় তরমুজ ক্ষেতের বাঁশের মাচা। তবে আটক করা হয় নি কাউকে। পরে জব্দকৃত মালামাল হস্তান্তর করা হয় গলাচিপা থানাতে। ভুক্তভোগী কৃষক আব্দুল মান্নানকে থানায় মামলা করার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু এরপরই শুরু হয় বিপত্তি। কৃষক আব্দুল মান্নান আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে থানার অফিসার ইনচার্জ মনির হোসেন মামলা না নিয়ে তাকে হেনস্তা করেন। এসময় ভ‚মিদস্যু শিহাবের সাথেও যোগাযোগ করেন ওসি । পরে জব্দকৃত ট্রলি ও সরকারি রিসিভারের জমির ধান পুরোটাই ফেরত দেয়া হয় অভিযুক্ত সেই শিহাবকে। আর এই সবকিছুর নির্দেশদাতা হিসেবে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি কাজী আলমগীর ও উপজেলা চেয়ারম্যান মুহম্মদ সাহিনের নাম উঠে এসেছে।

বলা হচ্ছে, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি কাজী আলমগীর ও উপজেলা চেয়ারম্যান মুহম্মদ সাহিনের নির্দেশেই থানা মামলা না নিয়ে উল্টো জব্দকৃত সবকিছু ফেরত দিয়েছে ভ‚মিদস্যু শিহাবকে। আর নীরবে তা সহ্য করেছেন ইউএনও, এসিল্যান্ড ও জেলার অভিভাবক জেলা প্রশাসক।       

জানা যায়, ২০০০ সালে চিংগুড়িয়া মৌজার প্রায় সাড়ে ৯৭ একর জমি আব্দুল মন্নান সরদারসহ প্রায় ১৬০ জন ভ‚মিহীন কৃষকদের চাষাবাদের জন্য বন্দোবস্ত দেয় সরকার। এরপর নতুন করে চর সৃষ্টি হলে মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৬২.১০ একর। ২০০২ সাল থেকে ভ‚মিহীন পরিবারগুলো জীবনকে নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশায় জমিতে চাষ শুরু করে। আর সরকার কর্তৃক নির্ধারিত চাষাবাদের জমির সীমানা পিলার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ অভাগা চাষীদের স্বপ্নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় ভ‚মিদস্যুরা। সীমানা পিলার ফেলে দিয়ে তারা জমি দখলের চেষ্টায় মামলা দায়ের করলে তা খারিজ করে দেয় আদালত।

কিন্তু তবুও থেমে থাকে নি ভ‚মি খেকোরা। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গলাচিপা থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ আক্তার মোর্শেদ ভ‚মিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমিতে রিসিভার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। চাষাবাদের জন্য তিনি টেন্ডারের মাধ্যমে ভ‚মিহীন কৃষকের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ৮ হাজার টাকার রশিদ দেন। এরপর সরকারি বন্দোবস্তকৃত সেই জমিতে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করে ৪০ মন ধান ফলায় ভ‚মিহীন কৃষক। চাষাবাদে সহায়তা এবং পরিদর্শনের অজুহাতে থানার বিভিন্ন কর্মকর্তা উৎকোচ হিসেবে নেন ২৫ হাজার টাকা।

আর যাতায়াত খরচ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা আদায় করেন তারা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চাষাবাদ খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা দিতে হবে সরকারি কোষাগারে। কিন্তু সোনার ফসল ঘরে তোলার আগেই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান লিকনের সহযোগিতায় ভ‚মিদস্যু শিহাবসব বিশাল একটি বাহিনী কৃষকদের কষ্টের অর্জিত ফসল জোরপূর্বক কেটে নেয়।

সেসময় ওসির পরামর্শে ভ‚মিহীন কৃষকরা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে তদন্তের নামে আবারও গলাচিপা থানা পুলিশকে দিতে হয় ৩২ হাজার টাকা। কিন্তু তবুও কোন বিচার পায় নি অভাগা ভ‚মিহীন কৃষকরা। শুধু ফসল লুট করেই ক্ষান্ত হয়নি ভ‚মিদস্যুরা, ভ‚মিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমিও দখল করে নেয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।

ইতিমধ্যে অসংখ্য জমি দখলে নিয়েছে ভ‚মিদস্যুরা। নদী ভাঙ্গনের চেয়েও ভয়ানক ভ‚মিদস্যুদের করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে অসহায় কৃষকরা জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার পর থেকে থানায় ও আদালতে প্রায় ডজন খানেক মামলা করেছেন, বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন তারও বেশি। ২০১২ সালে ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের করা (সি.আর-৭৬৮/১২) মামলার তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখ ভ‚মিদস্যু শিহাব ও তার সহযোগীরা অনধিকার প্রবেশের মাধ্যমে ভ‚মিহীন কৃষকদের উপর হামলা চালায়। গলাচিপা থানার তৎকালীন এসআই সৈয়দ সফিউল হোসেন সরেজমিন তদন্ত করে ২০১২ সালের নভেম্বরের ১৩ তারিখ ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে আদালতে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

গলাচিপা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কাজী মো: সায়েমুজ্জামান ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর একটি তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানান, স্থানীয় কয়েকজন ভ‚মিদস্যুর নেতৃত্বে বিনা উষ্কানিতে গলাচিপা উপজেলার চিংগুড়িয়া মৌজার বিরোধপূর্ণ জমিতে প্রবেশ করে বন্দোবস্ত প্রাপ্তদের বিভিন্নভাবে বাঁধা প্রদান করছে। তাদের অবৈধ বাঁধায় চলতি বছর প্রায় ২০ একর জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হয় নি। বাকী জমিতে ধান আবাদ করা হলেও তা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও প্রাণহানীর আশংকা রয়েছে।

২০১৪ সালের নভেম্বরে আমখোলা ইউনিয়ন ভ‚মি অফিসের সহকারী ভ‚মি কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে পুনরায় সীমানা পিলার স্থাপনের জন্য মতামত প্রদান করেন। ২০১৫ সালে গলাচিপা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কাজী মো: সায়েমুজ্জামান সি.আর ৭০৪/১৪ নম্বর মামলার তদন্ত রিপোর্টে বলেন, চিংগুড়িয়ার বন্দোবস্তপ্রাপ্ত জমির মালিকরা গলাচিপা নদীর যেপাড়ে বসবাস করেন তার অপর পাড়ে চাষাবাদকৃত জমি। আর এ কারণে চাষাবাদের জন্য তাদের নদী পাড়ি দিতে হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিহাব ও তার সহযোগিরা জমি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভ‚মিদস্যুরা জোরপূর্বক কৃষকদের ধান কেটে নিয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া সীমানা পিলারও তুলে নিয়ে যায় তারা। সি. আর ৭০৪/১৪ নম্বর মামলার তদন্ত প্রতিবেদনেও ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে ধান কেটে নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ২০১৫ সালের আগষ্টে সরকারের পক্ষ থেকে পুণরায় পাকা পিলার স্থাপন করা হলেও তা অমান্য করে চাষাবাধে বাঁধা সৃষ্টি করে ভ‚মিদস্যুরা।

এ নিয়ে ২০১৬ সালের নভেম্বরে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগী কৃষকরা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আমখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, শিহাব ও তার সহযোগীরা গায়ের জোরে কৃষকদের জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সভায় গলাচিপা উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা টিটো ভ‚মিদস্যু শিহাবের বিরুদ্ধে আইন গতভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু তবুও অভাগা কৃষকরা কিছুতেই রেহাই পান নি ভ‚মিদস্যুদের হাত থেকে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ভ‚মিহীন কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, ভ‚মিদস্যু শিহাব ও তার বাহিনী বন্দোবস্তকৃত জমিতে অবৈধভাবে মাটি খনন করছে। এর প্রেক্ষিতে উপজেলা ভ‚মি অফিসের সার্ভেয়ার মো: মজিবুর রহমান তদন্ত প্রতিবেদনে জানান, ২ টি পিলার উত্তোলন করে আমখোলা মৌজায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে ডেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটছে ভ‚মিদস্যুরা। এরপর আদালত থেকে গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জকে বিরোধপূর্ণ জমির মধ্যে ১৬.৫০ একর জায়গার রিসিভার নিয়োগ দেয়া হলে এক বছরের বন্দোবস্তের জন্য উন্মুক্ত ডাকের আহবান করা হয়। টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে ভুক্তভোগী আব্দুল মন্নান সর্বোচ্চ ডাকদাতা হিসেবে বন্দোবস্ত পান।

কিন্তু তারপরও ভ‚মিদস্যুরা সরকারি খাসজমিসহ ভ‚মিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। বর্তমানে বন্দোবস্তকৃত জমি চাষাবাদ করতে না পারায় চলতি বছরের জুন মাসে ভ‚মিদস্যু সিহাব ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে ভ‚মিহীন কৃষকরা জেলা পুলিশ সুপার বরাবর আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। এদিকে অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে গলাচিপা থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ আক্তার মোর্শেদ টেন্ডারের মাধ্যমে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে প্রশ্ন এড়িয়ে যান। এর কিছু সময় পর তিনি ভুক্তভোগী আব্দুল মান্নান নামে একজন ভ‚মিহীন কৃষককে ফোন দিয়ে দেখা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি পরও আক্তার মোর্শেদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।

জলবায়ুর পরিবর্তন আর নদীর করাল গ্রাসে সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবছর উদ্বাস্তু হচ্ছেন নদীপারের হাজার হাজার মানুষ। ভ‚মিহীন হয়ে পরিবারগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে এ ধার থেকে ও ধারে। কিন্তু ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এসব ভ‚মিহীন পরিবারের দু:খ-দুর্দশা দেখার কেউ নেই। ফলে প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার মাঝে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে ফেরা মানুষগুলোর জীবনে সুখের ছায়া আর দীর্ঘ হয় না। তার আগেই একদিকে নদীভাঙনের হাহাকার, অন্যদিকে প্রভাবশালীদের অত্যাচারে সর্বস্ব হারিয়ে থমকে দাঁড়ায় বেঁচে থাকার স্বপ্নও! তবু তারা ঘুরে দাঁড়াতে চায়।

আশায় বুক বেঁধে ফের পাড়ি দিতে চায় জেগে ওঠা এক চর থেকে অন্য চরে—জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার বাসনায়। এসব ভাসমান মানুষের বেশিরভাগেরই ঠিকানা নদীর বুকে জেগে ওঠা নতুন চর, বেড়িবাঁধ কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু নদীর ভয়াল ভাঙ্গনের চেয়ে আরও বেশি আগ্রাসী মানুষদের অত্যাচারে পিষ্ঠ নদী ভাঙা মানুষরা। এমনই একটি চর পটুয়াখালীর গলাচিপার আমখোলা মৌজার চিংগুড়িয়া। ভ‚মিদস্যুদের অত্যাচারে নির্যাতনে পথের মানুষগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে বেঁচে থাকার শেষ স্বপ্নটুকু।

জানা যায়, ২০০০ সালে চিংগুড়িয়া মৌজার প্রায় সাড়ে ৯৭ একর জমি আব্দুল মন্নান সরদারসহ প্রায় ১৬০ জন ভ‚মিহীন কৃষকদের চাষাবাদের জন্য বন্দোবস্ত দেয় সরকার। এরপর নতুন করে চর সৃষ্টি হলে মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৬২. ১০ একর। ২০০২ সাল থেকে ভ‚মিহীন পরিবারগুলো জীবনকে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশায় জমিতে চাষ শুরু করে। আর সরকার কর্তৃক নির্ধারিত চাষাবাদের জমির সীমানা পিলার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ অভাগা চাষীদের স্বপ্নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় ভ‚মিদস্যুরা।

সীমানা পিলার ফেলে দিয়ে তারা জমি দখলের চেষ্টায় মামলা দায়ের করলে তা খারিজ করে দেয় আদালত। কিন্তু তবুও থেমে থাকে নি ভ‚মি খেকোরা। অভিযোগসূত্রে জানা যায়, গলাচিপা থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ আক্তার মোর্শেদ ভ‚মিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমিতে রিসিভার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। চাষাবাদের জন্য তিনি টেন্ডারের মাধ্যমে ভ‚মিহীন কৃষকের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ৮ হাজার টাকার রশিদ দেন। এরপর সরকারি বন্দোবস্তকৃত সেই জমিতে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করে ৪০ মন ধান ফলায় ভ‚মিহীন কৃষক। চাষাবাদে সহায়তা এবং পরিদর্শনের অজুহাতে থানার বিভিন্ন কর্মকর্তা উৎকোচ হিসেবে নেন ২৫ হাজার টাকা।

আর যাতায়াত খরচ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা আদায় করেন তারা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চাষাবাদ খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা দিতে হবে সরকারি কোষাগারে। কিন্তু সোনার ফসল ঘরে তোলার আগেই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান লিকনের সহযোগিতায় ভ‚মিদস্যু শিহাবসব বিশাল একটি বাহিনী কৃষকদের কষ্টের অর্জিত ফসল জোরপূর্বক কেটে নেয়। সে সময় ওসির পরামর্শে ভ‚মিহীন কৃষকরা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে তদন্তের নামে আবারও গলাচিপা থানা পুলিশকে দিতে হয় ৩২ হাজার টাকা। কিন্তু তবুও কোন বিচার পায় নি অভাগা ভ‚মিহীন কৃষকরা।

শুধু ফসল লুট করেই ক্ষান্ত হয়নি ভ‚মিদস্যুরা, ভ‚মিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমিও দখল করে নেয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে অসংখ্য জমি দখলে নিয়েছে ভ‚মিদস্যুরা। নদী ভাঙ্গনের চেয়েও ভয়ানক ভ‚মিদস্যুদের করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে অসহায় কৃষকরা জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার পর থেকে থানায় ও আদালতে প্রায় ডজন খানেক মামলা করেছেন, বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন তারও বেশি।

২০১২ সালে ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের করা (সি.আর-৭৬৮/১২) মামলার তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখ ভ‚মিদস্যু শিহাব ও তার সহযোগীরা অনধিকার প্রবেশের মাধ্যমে ভ‚মিহীন কৃষকদের উপর হামলা চালায়। গলাচিপা থানার তৎকালীন এসআই সৈয়দ সফিইল হোসেন সরেজমিন তদন্ত করে ২০১২ সালের নভেম্বরের ১৩ তারিখ ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে আদালতে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

গলাচিপা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কাজী মো: সায়েমুজ্জামান ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর একটি তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানান, স্থানীয় কয়েকজন ভ‚মিদস্যুর নেতৃত্বে বিনা উষ্কানিতে গলাচিপা উপজেলার চিংগুড়িয়া মৌজার বিরোধপূর্ণ জমিতে প্রবেশ করে বন্দোবস্ত প্রাপ্তদের বিভিন্নভাবে বাঁধা প্রদান করছে। তাদের অবৈধ বাঁধায় চলতি বছর প্রায় ২০ একর জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হয় নি। বাকী জমিতে ধান আবাদ করা হলেও তা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও প্রাণহানীর আশংকা রয়েছে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে আমখোলা ইউনিয়ন ভ‚মি অফিসের সহকারী ভ‚মি কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে পুনরায় সীমানা পিলার স্থাপনের জন্য মতামত প্রদান করেন।

২০১৫ সালে গলাচিপা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কাজী মো: সায়েমুজ্জামান সি.আর ৭০৪/১৪ নম্বর মামলার তদন্ত রিপোর্টে বলেন, চিংগুড়িয়ার বন্দোবস্তপ্রাপ্ত জমির মালিকরা গলাচিপা নদীর যেপাড়ে বসবাস করেন তার অপর পাড়ে চাষাবাদকৃত জমি। আর এ কারণে চাষাবাদের জন্য তাদের নদী পাড়ি দিতে হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিহাব ও তার সহযোগিরা জমি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভ‚মিদস্যুরা জোরপূর্বক কৃষকদের ধান কেটে নিয়ে যায়।

সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া সীমানা পিলারও তুলে নিয়ে যায় তারা। সি.আর ৭০৪/১৪ নম্বর মামলার তদন্ত প্রতিবেদনেও ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে ধান কেটে নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ২০১৫ সালের আগষ্টে সরকারের পক্ষ থেকে পুণরায় পাকা পিলার স্থাপন করা হলেও তা অমান্য করে চাষাবাধে বাঁধা সৃষ্টি করে ভ‚মিদস্যুরা। এ নিয়ে ২০১৬ সালের নভেম্বরে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগী কৃষকরা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আমখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, শিহাব ও তার সহযোগীরা গায়ের জোরে কৃষকদের জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।

একই সভায় গলাচিপা উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা টিটো ভ‚মিদস্যু শিহাবের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু তবুও অভাগা কৃষকরা কিছুতেই রেহাই পান নি ভ‚মিদস্যুদের হাত থেকে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ভ‚মিহীন কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, ভ‚মিদস্যু শিহাব ও তার বাহিনী বন্দোবস্তকৃত জমিতে অবৈধভাবে মাটি খনন করছে। এর প্রেক্ষিতে উপজেলা ভ‚মি অফিসের সার্ভেয়ার মো: মজিবুর রহমান তদন্ত প্রতিবেদনে জানান, ২ টি পিলার উত্তোলন করে আমখোলা মৌজায় অবৈধভাবে  অনুপ্রবেশ করে ডেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটছে ভ‚মিদস্যুরা।

এরপর আদালত থেকে গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জকে বিরোধপূর্ণ জমির মধ্যে ১৬.৫০ একর জায়গার রিসিভার নিয়োগ দেয়া হলে এক বছরের বন্দোবস্তের জন্য উন্মুক্ত ডাকের আহবান করা হয়। টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করে ভুক্তভোগী আব্দুল মন্নান সর্বোচ্চ ডাকদাতা হিসেবে বন্দোবস্ত পান। কিন্তু তারপরও ভ‚মিদস্যুরা সরকারি খাসজমিসহ ভ‚মিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

বর্তমানে বন্দোবস্তকৃত জমি চাষাবাদ করতে না পারায় চলতি বছরের জুন মাসে ভ‚মিদস্যু সিহাব ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে ভ‚মিহীন কৃষকরা জেলা পুলিশ সুপার বরাবর আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। এদিকে অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে গলাচিপা থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ আক্তার মোর্শেদ টেন্ডারের মাধ্যমে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে প্রশ্ন এড়িয়ে যান। এর কিছু সময় পর তিনি ভুক্তভোগী আব্দুল মন্নান নামে একজন ভ‚মিহীন কৃষককে ফোন দিয়ে দেখা করার প্রস্তাব দেন।

পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহাজাদা বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। ইতিমধ্যে ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তবে সংসদ সদস্যের নির্দেশনার পরও বিন্দুমাত্র ভাগ্য পাল্টে নি ভ‚মিহীন হতভাগা কৃষকদের। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে বর্গা চাষীদের দিয়ে তরমুজের চাষ করে শিহাব।

অসহায় ভুক্তভোগীরা এর প্রতিকার চেয়ে মামলা করতে গেলেও মন গলে নি গলাচিপা থানার ওসি শওকত মিজানের। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, চাষীদের পিলার বানাতে বলা হয়েছে। খুব শীঘ্রই পিলার দিয়ে জমি ভুক্তভোগীদের বুঝিয়ে দেয়া হবে। এদিকে ইউএনও’র কথামতো পিলার বানানো হলেও জমি বুঝিয়ে বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয় নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভ‚মিহীন অসহায় কৃষক পরিবারগুলো।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

17 − 12 =