ক্ষতিকর রাসায়নিক নিয়ে বিশ্ব সোচ্চার, বাংলাদেশ কবে হবে

0
619

এখনকার সময়ের মোটামুটি সচ্ছল মানুষের ঘরে অবশ্যই ফ্রাইপ্যান, মাইক্রোওয়েভ বা জ্যাকেটের মতো জিনিসপত্র থাকে। এগুলোর এখন নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। এমন বহু পণ্যের নাম বলা যায়, যেগুলো দৈনন্দিক জীবনকে সহজ করে তুলছে। আপনার কি মনে কখনো প্রশ্ন জাগে না, আপনার পছন্দের ফ্রাইপ্যানের সঙ্গে খাবার লেগে থাকে না কেন? মাইক্রোওয়েভে পপকর্ন ভেজে না কেন? কিংবা জ্যাকেটে পানি প্রবেশ করতে পারে না কেন?

এগুলো তো আপনা-আপনি হচ্ছে না। অবশ্যই কোনো কারণ আছে। আর সেটা হচ্ছে রাসায়নিক। এক প্রকার রাসায়নিকের প্রলেপ থাকার কারণে এমন হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাসায়নিকটি কৃত্রিম শ্রেণিভুক্ত। এর নাম পলি অ্যান্ড পারফ্লুরোঅ্যালকাইল পদার্থ বা সংক্ষেপে পিএফএএস। এই শ্রেণিতে ৪ হাজার ৭০০-এর বেশি যৌগ রয়েছে। তবে এই রাসায়নিকগুলোর বিষয়ে এখন আগের চেয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। অনেক অঞ্চলে এই রাসায়নিকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র গত জুলাই মাসে এই রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা আগামী ২০৩০ সাল থেকে কার্যকর হবে। তবে মেডিকেল সরঞ্জাম তৈরির মতো জরুরি কাজে এর ব্যবহার আগের মতোই থাকবে। অর্থাৎ, এ ধরনের জরুরি ক্ষেত্রগুলোতে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না।

ইউরীপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতেও এ কৃত্রিম রাসায়নিকের ব্যবহার সীমিত করেছে। পিএফএএসের ব্যবহারের ওপর আরোপ করেছে বিধিনিষেধ। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নন পরিবেশবাদীরা। তাঁরা বলছেন, শুধু এটুকুতে হবে না। পিএফএএসসহ এই গোষ্ঠীর সব রাসায়নিককে এই নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে তাঁরা চান, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কী কী রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, তা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য দিক উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। তা না হলে বিকল্প পদার্থটি যে আরও ক্ষতিকর হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।

এই পর্যন্ত এসে থামা যাক। এখন স্বাভাবিক যে প্রশ্ন ওঠার কথা তা হলো—কেন এটা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে? এই রাসায়নিক তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তুলছে। তাহলে কেন এ বৈরীতা?

এটা সত্য যে, এই রাসায়নিক অনেক কিছুকেই সহজ করেছে। আর এই সহজীকরণের পথে তার যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে, তা হলো এর স্থায়ীত্ব। এ কারণে আজ যে ফ্রাইপ্যান কেনা হলো, তা প্রতিদিন ব্যবহারের পরও প্রায় অবিকৃত অবস্থায় থেকে যাবে দীর্ঘদিন। কিংবা যে জ্যাকেট পরা হচ্ছে, তা ঝড়-বৃষ্টি ইত্যাদি ডিঙিয়ে ঠিকই পানিরোধী থেকে যাচ্ছে। এই যে দীর্ঘস্থায়িত্ব, এর কারণেই এই রাসায়নিককে ‘চিরকালীন রাসায়নিক’ বলা হয়। পানি, ধুলা, এমনকি মানুষের রক্তেও এই রাসায়নিকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। খাদ্য প্যাকেজিং থেকে শুরু করে প্রসাধনী এবং আসবাবপত্রেও এই রাসায়নিক পাওয়া যায়। নানাভাবে এই রাসায়নিক শরীরে প্রবেশ করে। কিন্তু এটা তো শরীরের স্বাভাবিক উপাদান নয়। ফলে বাইরে থেকে শরীরে প্রবেশ করা এই রাসায়নিক লিভারে ক্ষতি, ক্যানসার, জন্মগত নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে।

পিএফএএসের ব্যবহার এতটাই বেশি এবং মানুষের সংস্পর্শে এই রাসায়নিক এতই বেশি এসেছে যে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে খুবই নিশ্চিত বিবৃতির মতো করে বলা হয়েছে, ‘আপনার ঘরে এবং আপনার শরীরে অবশ্যই পিএফএএসের উপস্থিতি রয়েছে।’

এই রাসায়নিক কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে, তার একটা ধারণা পাওয়া যেতে ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘ডার্ক ওয়াটার’ থেকে। যেসব অঞ্চলে পিএফএএসের ব্যবহার খুব বেশি এবং এ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারের পর উন্মুক্ত পরিবেশে ফেলা হয়, সেসব অঞ্চলে এমন ভয়াবহ ধরনের দূষণের শিকার হতে পারে মানুষ। কিন্তু মানুষকে এটা বোঝানো এখন ভীষণ কঠিন। এর ভোক্তা শ্রেণি এতই বড় যে, চাইলেও এর রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না।

রাসায়নিকের নিরাপদ ব্যবহার নিয়ে কাজ করা সুইডিশ অলাভজনক সংস্থা কেসমেকের জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ ও ব্যবসায়িক উপদেষ্টা জোনাথন ক্লেইমার্ক বিবিসিকে বলেন, ‘নিয়মিত ব্যবহারকারীদের ওপর এই রাসায়নিকের প্রভাব বেশ জটিল, যা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। এদিকে মানুষের হাতেও সময় খুব কম। ফলেনিজেদের পণ্যে পিএফএএস রয়েছে কিন-না, সে প্রশ্নের উত্তর আর দিতে হচ্ছে না উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এমনকি কিছু নির্মাতা বুঝতেই পারেন না যে, তাঁরা তাদের পণ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এই রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন চাইলে অবশ্যই একটি নীতিমালা থাকতে হবে। কারণ, কোম্পানিগুলো শেষ পর্যন্ত নীতিমালাই মেনে চলার চেষ্টা করে। পিএফএএস ব্যবহার বন্ধ করতে হলে নিষেধাজ্ঞার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, একমাত্র তখনই কোম্পানিগুলো এর বিকল্প খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।’

এ নিয়ে অবশ্য রাসায়নিক বিকল্প কারখানা মালিকদের মধ্যেও এক ধরনের নড়াচড়া শুরু হয়েছে। তারা এরই মধ্যে এই রাসায়নিককে অন্য কোনো বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপনের জন্য আলোচনা শুরু করেছে। তারা এ সম্পর্কিত একটি নির্দেশনাও চাইছে। ইউরোপিয়ান কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রি কাউন্সিলের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া হয়েছে। তারা বলে দিয়েছে, পিএফএএসের প্রতিস্থাপক খুঁজে বের করতে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে এ বিষয়ে তারা আরও স্বচ্ছতা চায়। তবে সব শিল্পের ক্ষেত্রে এই বিকল্প খুঁজে পাওয়াটা সহজ নয়। তবে রাসায়নিক শিল্পমালিকেরা চান, তাঁরা যে বিকল্প ব্যবহার করছেন, তা সম্পর্কে আরও তথ্য মানুষ জানুক। ধীরে ধীরে তাঁরা যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রতিস্থাপন করছেন, সে তথ্য আরও প্রচার হোক।

পিএফএএস গোষ্ঠীর বহুল ব্যবহৃত রাসায়নিক পলিটেট্রাফ্লুরোইথিলিন (পিটিএফই)। মূলত পানিরোধী স্বভাবের জন্যই এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। টেফলন নামে সমধিক পরিচিত এই রাসায়নিকের বিকল্প এরই মধ্যে খুঁজে বের করেছে অরগানোক্লিক নামের সুইডিশ এক প্রতিষ্ঠান। তারা এই বিকল্প রাসায়নিকটির নাম দিয়েছে অরগানোটেক্স। ১৯৪১ সালে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ডুপন্ট এই টেফলনের পেটেন্ট নিয়েছিল। তারপর থেকে মোটামুটি এর রাজত্ব শুরু হয়, যা আজও চলছে। মানুষের রান্নাঘর থেকে শুরু করে মহাকাশে নভোচারীদের সঙ্গী পর্যন্ত হয়েছে এই টেফলন। পানিরোধী, হালকা, অতি কম মাত্রার ঘর্ষণ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য একে ভীষণ জনপ্রিয় করে তোলে। এখন এই অতিব্যবহার ও এর ক্ষতিকর প্রভাবের জেরে বিকল্প রাসায়নিকের দিকে চোখ দিতে হলো মানুষকে।

সারা বিশ্বেই ক্ষতিকর রাসায়নিক নিয়ে একটা জনমত গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এই সচেতনতা পলিথিনে সীমাবদ্ধ। এমনকি এই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে নানা উপাদানের কথা বারবার এলেও তা জনপ্রিয় করতে তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সরকার বিভিন্ন সময় এ নিয়ে কিছু কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে তেমন কিছু দেখা যায় না। পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতাকে এখনো এ দেশে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এর সঙ্গে সরাসরি জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত। টেফলন বা পিএফএএস গোত্রভুক্ত বিভিন্ন রাসায়নিক নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন সরঞ্জামের সঙ্গে এমনভাবে মিশে রয়েছে যে, তা প্রতিনিয়ত মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।

এ থেকে কত বিচিত্র ধরনের রোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। দেশে কিডনি রোগ কিংবা ক্যানসারের বাড়বাড়ন্তের দিকে তাকালে এটি কিছুটা বোঝা যাবে। কিন্তু এই দৃষ্টিটি কে দেবে? এ ধরনের রাসায়নিকের বিকল্প খোঁজার ক্ষেত্রে প্রাথমিক যে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ, তারও কোনো দেখা নেই। নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তো অনেক দূরের ব্যাপার। বরং পশ্চিম যখন এই পণ্যগুলো সীমিত করতে নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে, তখন তা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে প্রবেশ করছে হরদম। আর এ দেশের মানুষও আগের চেয়ে কম দামে এ ধরনের পণ্য পেয়ে বর্তে যাচ্ছে, যা আত্মহত্যারই শামিল।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

two × five =