মাওলানা মুহাম্মদ আলি’র মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা

0
435

মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর ছিলেন একজন ভারতীয় মুসলিম নেতা, আন্দোলনকারী, পন্ডিত, সাংবাদিক ও কবি। তিনি খিলাফত আন্দোলনের মূল নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন।ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুসলিম প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনি ষষ্ঠতম। তিনি কয়েকমাস এ পদে ছিলেন। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট।মুহাম্মদ আলি ১৮৭৮ সালে ভারতের রামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাওলানা শওকত আলি ও জুলফিকার আলির ভাই। পিতার অকালমৃত্যুর পর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৮৯৮ সালে অক্সফোর্ডের লিঙ্কন কলেজে আধুনিক ইতিহাস অধ্যয়ন করেন।

ভারত ফিরে মুহাম্মদ আলি রামপুর রাজ্যের শিক্ষা নির্দেশক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। পরে তিনি বড়োদরা সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি একজন লেখক ও বক্তা হয়ে উঠেন। ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় প্রধান ইংরেজি ও ভারতীয় সংবাদপত্রে তিনি অবদান রাখেন। ১৯১১ সালে তিনি উর্দুতে হামদর্দ ও ইংরেজিতে দ্য কমরেড নামক সাপ্তাহিক চালু করেন। ১৯১৩ মুহাম্মদ আলি দিল্লী ফিরে আসেন।

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণের জন্য মুহাম্মদ আলি কাজ করেছেন। এসময় তার নাম ছিল মোহামেডান এংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ। তিনি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার একজন সহপ্রতিষ্ঠাতা। এটি পরে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।

১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা বৈঠকে মুহাম্মদ আলি অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি এই দলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপালন করেন। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তিনি লীগে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ডে মুসলিম প্রতিনিধিদলে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। এ দলের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কের সুলতান ও মুসলিমদের খলিফাকে যাতে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক‌ ক্ষমতাচ্যুত না করেন সে বিষয়ে প্রভাবিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে রাজি করানো। ব্রিটিশরা তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ফলে খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি ভারতের মুসলিমদের সরকারের প্রতিবাদ ও বয়কটে নেতৃত্ব দেয়।

এসময় মাওলানা মুহাম্মদ আলি ১৯২১ সালে মুসলিম জাতীয়তাবাদিদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন এতে ছিলেন মাওলানা শওকত আলি, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান, মুখতার আহমেদ আনসারি। এছাড়া মহাত্মা গান্ধীও এতে ছিলেন। গান্ধী মুসলিমদের সাথে ঐক্যের নিদর্শন হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও হাজার হাজার হিন্দুর সমর্থন অর্জন করেন। একইসাথে মুহাম্মদ আলি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন দেন এবং ভারতজুড়ে কয়েকশত প্রতিবাদে উৎসাহ দেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। খিলাফত সম্মেলনের সময় রাজদ্রোহী বক্তৃতার দায়ে তিনি দুইবছরের জন্য কারারুদ্ধ হন।

১৯২৩ সালে মাওলানা মুহাম্মদ আলি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতা ও চৌরি-চৌরা ঘটনার পর মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে মুহাম্মদ আলি মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন। তিনি তার সাপ্তাহিক হামদর্দ পুনরায় চালু করেন এবং কংগ্রেস ত্যাগ করেন। তিনি নেহেরু রিপোর্টের বিরোধিতা করে। এতে সাংবিধানিক সংস্কার এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে স্বাধীন জাতি হিসেবে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাসের প্রস্তাব করা হয়। মোতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের হিন্দু ও মুসলিম সদস্যদের একটি কমিটি এই রিপোর্ট লেখে। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রধান প্রতিবাদ ছিল। কমিশন সংস্কার প্রস্তাবের জন্য ভারতে আসে কিন্তু তাতে ভারতের দাবির প্রতি কর্ণপাত করা হয়নি। এসময় মুহাম্মদ আলি কারাগারে ছিলেন। তাই সর্বদলীয় সম্মেলনে নেহেরু রিপোর্ট শওকত আলি, বেগম মুহাম্মদ আলি ও কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির ৩০ জন অন্যান্য সদস্য কর্তৃক নেহরু রিপোর্ট উত্থাপিত হয়। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মজিদ দরিয়াবাদি, আজাদ সোবহানি, মাগফুর আহমেদ আজাজি, আবুল মহসিন মুহাম্মদ সাজ্জাদ ও অন্যান্যরা। মুহাম্মদ আলি নেহেরু রিপোর্টের মুসলিমদের পৃথক নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও লীগের ১৪ দফার প্রতি সমর্থন জানান। অন্যান্য মুসলিম নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান ও মুখতার আহমেদ আনসারির বিপরীতে গিয়ে তিনি গান্ধীর সমালোচনা করেন। তারা গান্ধী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন করতেন।

তৃতীয় আগা খানকে চেয়ারম্যান করে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে মাওলানা মুহাম্মদ আলি অংশগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সরকার করাচির খালিকদিনা হলে আদালত স্থাপন করে। এতে তাকে আড়াই বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।

বেশ কিছু স্থানের নাম মাওলানা মুহাম্মদ আলির নামে করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে : মাওলানা মুহাম্মদ আলি (এমএমএ) হোস্টেল, মহসিনুল মুলক হল, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড়, ভারত মাওলানা মুহাম্মদ আলি মার্গ, নয়াদিল্লী, ভারত, সাদায়ে জওহর ম্যাগাজিন, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, নয়াদিল্লী মুহাম্মদ আলি রোড, দক্ষিণ মুম্বাই, ভারত, গুলিস্তানে জওহর, করাচির নিকটে, পাকিস্তান, মুহাম্মদ আলি কোঅপারেটিভ হাউসিং সোসাইটি, করাচি জওহর টাউন, লাহোর, পাকিস্তান; জওহরাবাদ, পাঞ্জাবের একটি শহর, পাকিস্তান করাচির জওহরাবাদ এলাকা ; মাওলানা মুহাম্মদ আলি মসজিদ, সিঙ্গাপুর ; গান্ধী মুহাম্মদ আলি মেমোরিয়াল ইন্টার কলেজ, উত্তর প্রদেশ, ভারত ; মুহাম্মদ আলি জওহর বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর একাডেমি অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া, নয়াদিল্লী, ভারত ; তার ইংরেজি সাংবাদিকতা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামায় একটি পৃথক ইংরেজি গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে, লখনৌ, ভারত ; জওহর হোস্টেল, সিন্ধ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় টানডো জাম, সিন্ধ, পাকিস্তান; মুহাম্মদ আলি জওহর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কালিকট জেলা, কেরালা, ভারত; মওলানা মুহম্মদ আলি সড়ক, দামপাড়া, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ; মওলানা মুহম্মদ আলি কলেজ, টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ।

“I had long been convinced that here in this Country of hundreds of millions of human beings, intensely attached to religion, and yet infinitely split up into communities, sects and denominations, Providence had created for us the mission of solving a unique problem and working out a new synthesis, which was nothing low than a Federation of Faiths… For more than twenty years I have dreamed the dream of a federation, grander, nobler and infinitely more spiritual than the United States of America, and today when many a political Cassandra prophesies a return to the bad old days of Hindu-Muslim dissensions I still dream that old dream of “United Faiths of India.” — মুহাম্মদ আলি; প্রেসিডেন্সিয়াল ভাষণ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সেশন, ১৯২৩, কোকানডা (বর্তমান কাকিনাডা)।

তিনি ছিলেন উপমহাদেশ এবং মুসলিম বিশ্বের সর্বাধিক গতিশীল এবং বহুমুখী নেতা। তিনি একই সাথে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থার সাতগুণ বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিলেন, যেমন: শিক্ষাবিদ কবি সাংবাদিক রাজনীতিবিদ ইসলামী পণ্ডিত দানবিক মুক্তিযোদ্ধা উপরোক্ত গুণাবলীর পাশাপাশি তিনি ইংরেজি ও উর্দু উভয় ক্ষেত্রেই একজন চমৎকার বক্তা ও বক্তা ছিলেন। এইচ জি ওয়েলস তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন “তাঁর হৃদয় নেপোলিয়ন, ম্যাকোলে কলম এবং বার্কের জিহ্বা ছিল” তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল ভারত ও মুসলিম বিশ্বের স্বাধীনতার বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী যোদ্ধা হিসাবে তাঁর ভূমিকা এবং সাহসের সাথে কথা বলেছিলেন ১৯৩০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় রাউন্ড টেবিল সম্মেলন উপলক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে এবং নিম্নলিখিত সোনার কথায় বলেছিলেন: “আমি কোন দাস দেশে যাব না, আমার দেশকে স্বাধীনতা দিন, আপনি যদি স্বাধীনতা দিতে না পারেন, তবে আপনাকে করতে হবে আমাকে এখানে আমার সমাধির জন্য জায়গা দিন। “

মাওলানা মুহাম্মদ আলীর শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো উপমহাদেশে খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা। তুর্কি খেলাফত রক্ষায় ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উপমহাদেশে খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। আলী ভ্রাতৃদ্বয় মুহাম্মদ আলী ও শওকত আলী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. এম এ আনসারী ও হজরত মোহানীর নেতৃত্বে এ আন্দোলন সূচিত হয়। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯১৯ সালে অহিংস আন্দোলন ‘সত্যাগ্রহ’ শুরু করেন। তাঁর আন্দোলনের প্রতি মুসলমানদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য গান্ধী খেলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন। তাঁর সঙ্গে বহু হিন্দু মনীষী এই আন্দোলন সমর্থন করেন। ১৯২০ সালের মাঝামাঝি খেলাফত আন্দোলনের প্রতি গান্ধীর সমর্থনের বিনিময়ে খেলাফত নেতারা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এভাবে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গড়ে তোলে। জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দ তথা দেওবন্দের আলেমসমাজও এ আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কামাল আতাতুর্কের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে তুর্কি খেলাফত বিলুপ্ত হয়। ফলে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে খেলাফত আন্দোলনেরও বিলুপ্তি ঘটে।

আকস্মিকভাবে খেলাফত আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও এ আন্দোলনের ফলে যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, তা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর বাঙালি মুসলমানদের কাছে খুবই মূল্যবান বিবেচিত হয়। এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়।

১৯৩২ সালের ৪ জানুয়ারি মাওলানা মুহাম্মদ আলী লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী নবীদের পুণ্যভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসে তিনি সমাহিত হন। ফিলিস্তিনের প্রধান মুফতি তাঁর জানাজা পড়িয়েছেন। মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহারের ইন্তেকালের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো প্রভাবশালী নেতার চোখে পানি এসে যায়। তিনি বলেন, ‘ইসলামের সৈনিক আমাদের ছেড়ে দূরে চলে গেলেন।’  সত্যিই তাঁর মৃত্যুতে উপমহাদেশে মুসলমানরা রাজনৈতিক নেতাশূন্য হয়ে পড়ে।

কুব্বাত আস সাখরার কাছে তার কবরে উৎকীর্ণ রয়েছে, “এখানে শায়িত আছে সাইয়িদ মুহাম্মদ আলি আল হিন্দি”।

ভারতবর্ষে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির রূপকার মাওলানা মুহাম্মদ আলী’র মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

17 + three =