দেশের শতকরা ৭৩ শতাংশ জনগণ অনিরাপদ পানি পান করছে…..সবুজ আন্দোলন

0
368

মালিবাগ, ঢাকায় আন্তর্জাতিক নিরাপদ পানি দিবস উপলক্ষে “বিশুদ্ধ পানির সংস্থান—আনবে নিরাপদ জীবন” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ও নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। উদ্বোধন করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রফেসর ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোঃ আনোয়ার হোসেন, প্রত্যাশার বাংলাদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাতৃভূমি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম. মাইন উদ্দিন মিয়া, সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদের মহাসচিব মহসিন সিকদার পাভেল, বাংলা ট্রিবিউন’র সিনিয়র রিপোর্টার শাহেদ শফিক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ—সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদ ইসলাম, নাট্যব্যক্তিত্ব আবীর বাঙ্গালী। সভাপ্রধান ছিলেন সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদক অভিনেতা উদয় খান এবং সঞ্চালনায় করেন সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম চৌধুরী (অর্ণব)।

এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ—দপ্তর সম্পাদক আব্দুল আজিজ, নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পাদক এমএ মামুন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ— সভাপতি কনক চন্দ্র বর্মন, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন পলাশ,যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিয়া আক্তার, আইয়ুব আনসারী প্রমূখ।

প্রধান আলোচকের বক্তব্যে সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, আজ ২২ মার্চ ২০২২ ইং আন্তর্জাতিক নিরাপদ পানি দিবস। প্রতিবছর এই দিনে সারা পৃথিবীতে পানির ব্যবহার ও দূষণ থেকে মুক্ত রাখতে নিরাপদ পানি দিবস পালন করা হয়। সর্বপ্রথম ব্রাজিলে ১৯৯০ সালে ২২ মার্চ নিরাপদ পানি দিবস পালন করা হয়। তবে ১৯৯৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরাপদ পানি দিবস পালন করা হচ্ছে। এশিয়া অঞ্চলে সবথেকে নিরাপদ পানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে ভূ—গর্ভস্থ পানি কমে যাওয়া এবং লবণাক্ত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন তথ্য ও গবেষণা পরিষদ বিগত আট মাস সিটি কর্পোরেশন এলাকা এবং দেশের ২১ টি জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা ও সুপেয় পানি ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে। দেখা গেছে শহরের অধিকাংশ এলাকায় বিশেষ করে সিটি করপোরেশনে বসবাসরত জনগণ শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ অনিরাপদ পানি পান করছেন। ঢাকা সিটির ওয়াসার পানিতে আয়রন, ক্যাডমিয়াম, মিনি প্লাস্টিক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা দেখা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে যা প্রচার করা হয়েছে। আমাদের মতে উপকূলীয় অঞ্চলের শতকরা ৭৭ শতাংশ জনগণ অনিরাপদ পানি পান করার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। উঠতি বয়সী কিশোর কিশোরীরা কম পানি পান করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগ, নারীদের ক্ষেত্রে জরায়ু ক্যান্সার এবং বন্ধ্যাত্ব রোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।বাপ্পি সরদার আরো বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের শতকরা ৮০ শতাংশ জনগণ পুকুরের পানির উপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ফসলি জমি, পুকুর ও নদীতে ঢুকে পড়ায় লবণাক্ত পানির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ শতাংশ লবণাক্ত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে ২০৫০ সালে সারা বাংলাদেশে খাবার পানি ও সেচের পানির জন্য মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ সংকটে পড়বে। জরিপ করে দেখা যায় সারা বাংলাদেশে বর্তমানে সুপেয় পানি সংকটে ভুগছে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনগণ। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য প্রতি লিটারে ৪ টাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ১ টাকার অধিক গুনতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ খনন করতে ১ হাজার থেকে ২ হাজার মিটার গভীরে যেতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজের জন্য পানি সংকট চরম আকার ধারণ করে।

সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আরো বলেন, সারা পৃথিবীতে উন্নত রাষ্ট্র অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ও মিথেন গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে যার ফলে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের তলদেশে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের সময় পানির তীব্রতা, উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণ, জলাবদ্ধতা, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জল ও মাটি দূষণ এবং নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি পানি দূষণ জনিত জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জনগণ। বিশেষ করে চর্ম রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ২১ জেলায় স্বাদুপানির এলাকা ৫০ ভাগ থেকে কমে ৩৪ ভাগ হয়েছে। মৃদু লবণাক্ত এলাকা ৫২ ভাগ থেকে কমে ৪৬ ভাগ হয়েছে। যা আগামীতে প্রচন্ড লবণাক্ত এলাকা ৪ ভাগ থেকে বেড়ে ২০ ভাগে রূপান্তরিত হবে। বর্তমানে  ৩০ বছরে ১০ ভাগ এলাকা ও ১০ ভাগ তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সভায় নিরাপদ পানি ব্যবস্থা জোরদার করতে সবুজ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো:

১) ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের সংশোধন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জনসচেতনতার জন্য প্রচার—প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে।

২) সারা বাংলাদেশে নদীর নাব্যতা সংকট দূরীকরণে সকল নদী খননের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সমুদ্রের সাথে নদীর গতিপথকে সচল রাখতে হবে।

৩) বুড়িগঙ্গা নদীর সাথে সমুদ্রের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যার ফলে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের পানি সংকট দূর করা সম্ভব।

৪) নদীতে কলকারখানার বর্জ্য অপসারণ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ইটিপি ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাইপাস ক্যানাল পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং প্লাস্টিক পণ্য নদীতে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫) নদীর ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা, ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ বৃদ্ধি করা, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প বর্জ্য অপসারণে সতর্ক অবস্থা গ্রহণ করা, জাহাজ ডুবি রোদে ফিটনেস বিহীন নৌযান ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

৬) উপকূলীয় অঞ্চলে সরকার ও উন্নয়ন অংশীদার প্রকল্প জোরদার করা। যার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি এবং সুপেয় পানির নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব।

৭) ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে বিরত রাখতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সভা সেমিনার ও সমাবেশের ব্যবস্থা করা এবং পরিবেশ কর্মীদের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্টেকহোল্ডার বডি তৈরি করতে সচেষ্ট হতে হবে।

৮) মাটির উর্বরতার ধরে রাখতে কেমিক্যাল স্যারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করা, উন্নত বীজ,সার ও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার যন্ত্রাংশ সরবরাহ সরকারের পক্ষ থেকে যথা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৯) উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য মিনি হাসপাতাল নির্মাণ এবং নিরাপদ পানি ব্যবহারের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। ১০) গঁঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরী এবং আন্তদেশীয় নদী আইন অনুস্বরন বাস্তবায়নে কুটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 + fourteen =