প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী আইন নিয়ে আলোচনা বৈষম্যমূলক আচরণকে ”দন্ডনীয় অপরাধ” হিসেবে গণ্য করার আহ্বান

0
534

ঢাকা, ১৭ এপ্রিল, ২০২২: বাংলাদেশে যে ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ প্রতিনিয়ত ঘটে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বৈষম্যমূলক আচরণকে ”দন্ডনীয় অপরাধ” হিসেবে গণ্য করতে হবে বলে মনেকরেন এই আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। কারণ কোন আইনে ক্রিমিনাল প্রভিশন না থাকলে এটি প্রকৃতপক্ষে কোন আইন হবেনা।তারা মনেকরেন প্রস্তাবিত আইনে বৈষম্যমূলক আচরণ বা কার্যের ফলে ফৌজদারি প্রতিকারের কোন বিধান রাখা হয়নি, যা আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে। কারণ বৈষম্যের শিকার ব্যক্তির প্রতিকার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া এমনিতেই জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী।উল্লেখ নাগরিক সমাজ, আইন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বৈষম্য বিরোধী আইনের খসড়ায় বৈষম্যমূলক আচরণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করা হয়েছে এবং পাশাপাশি ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধানী রাখা হয়েছিল। কিন্তু উপস্থাপিত বিলে শাস্তির কোনো বিধান রাখা হয়নি।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী আইনটির উল্লেখযোগ্য অংশগুলো নিয়ে অনুষ্ঠিত এক ওয়েবিনারে এই কথাগুলো উঠে এসেছে। এই ওয়েবিনারে অংশ নেন আইনটির সাথে সংশ্লিষ্ট আইন প্রণেতা, বেসরকারী সংস্থার প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ।

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপ্রধান শহীদুজ্জামান সরকার। তিনি অনুরোধ করেছেন এই অনুষ্ঠানের সব সুপারিশমালা স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠাতে, যেন উনি সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে পারেন মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে।

ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারী বক্তারা বলেন যদিও প্রস্তাবিত বৈষম্য বিরোধী আইনে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে কোন অজুহাতেই কারো প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন বৈষম্য করা যাবে না, তথাপি কয়েকটি বিষয়ে আরো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন বলে আলোচকরা মনেকরেন। যেমন হিজরা, তৃতীয়লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি এবং দলিত জনগোষ্ঠী শব্দের সংজ্ঞা ও তফসিল থাকতে হবে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দলিত নেতা মিলন বিশ^াস বলেন ”উপযুক্ত কারন ছাড়া পিতৃ বা মাতৃ পরিচয় প্রদানে অসমর্থতার কারনে কোন শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি, অমত বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা বাধা প্রদান করা যাবে না” বলে আইনে যা বলা হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। কোন কোন কারণে কোন শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানানো যাবে বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে, তা সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। নয়তো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ কখনোই শিক্ষায় সমান সুযোগ পাবেনা।

এমজেএফ এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম অনুষ্ঠানটি পরিচালনাকালে বলেন, মানুষের মনোজগতে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা না গেলে, আইন করেও কোন লাভ হবেনা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করা। আইনের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষ যেন বিচার পায়, সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের লক্ষ্য মানুষকে ক্ষমতায়িত করার ক্ষেত্রে এই আইন কতটা যেতে পারে, তা দেখা। ভুক্তভোগী মানুষ নিজে যদি সরাসরি আদালতে শরণাপন্ন হতে না পারেন, তাহলে এ ধরনের আইন কতটা দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রকারান্তরে এটি আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।

এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অনেকেই বলেন আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু আমি বলতে চাই আইন তখনই কার্যকর হয়, যখন রাজনৈতিক ইচ্ছা দৃশ্যমান হয়, দক্ষ প্রশাসন থাকে এবং নাগরিকদের পক্ষ থেকে সক্রিয় মনিটরিং করা হয়। তিনি আরো বলেন, আইনে বৈষম্যের তালিকাটি আরো প্রসারিত ও সামগ্রিক করতে হবে।

চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা দেবাশীষ বলেন, আইনটিতে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তিনি বলেন আন্তর্জাতিক শ্রম আইন কনভেনশনের ১০৭ ও ১১১ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এখানে আদিবাসীদেও অধিকারের কথা বলা হয়েছে।

সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যরিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি এমপি বলেন, ”এই খসড়া আইনটি আমার কাছে খানিকটা অপেশাদার বলে মনেহয়েছে। মনিটরিং কমিশন নিয়েও আমি সন্দেহ পোষণ করছি। কারণ এখানে সব শ্রেণী পেশার লোকের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। এছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে আন্ত:মন্ত্রণালয় সমন্বয় নাই। এটা একটা কাঠামোগত ত্রুটি। ফলে বিচারের জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে ছুটে বেড়াতে হবে।”

আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রংও একটি শক্তিশালী মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা বলেন। নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন বলেন, যে খসড়া আইনটি প্রথমে প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেখানে ”বৈষম্য বিলোপ বা নিরসন” কথাটি ছিল। এখন বলা হচ্ছে ”বৈষম্য বিরোধী আইন”। এই সংজ্ঞাটি স্পষ্ট হওয়া দরকার।

যৌনকর্মী নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের শিশুরা মূলধারার স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়না, মায়ের পেশার কারণে। আইন প্রণয়ন বিষয়ক কমিটিতে যৌনকর্মীদের প্রতিনিধিত্ব নাই। একই অভিযোগ এসেছে হিজড়া, তৃতীয়লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির পক্ষ থেকে। ২০২০ সালে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, এখনো কোন সুযোগ তারা পাচ্ছেন না।

আইনটিতে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কোন বৈধ পেশা বা চাকুরী গ্রহন বা বৈধ ব্যবসা পরিচালনায় নিষিদ্ধ করা যাবে না। তাহলে যৌনকর্মীর পেশা বা ব্যবসা অবৈধ বলে গণ্য হবে তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আইনের মারপ্যাচে এখনো বৈধ অবৈধের মাঝখানে রয়ে গেছে। কাজেই ব্যাখ্যা দিয়ে এগুলো সুস্পষ্ট করার কথা বলেন বক্তারা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen + thirteen =