শেষ ১০ দিন, রমজানের ইবাদত ও আমল

0
378

১. রমজান পুরো বিশ্বের জন্য রহমাতের একটি মাস এই মাসেই মানব হেদায়েতের মহান কুরআন কারীম নাজিল হয়েছেন যাহ পুরো মানব সমাজের জন্য হেদায়েতের পদপ্রদর্শক । যাহ থেকে আমরা নিজেকে নবী কারিম (সা:) পথে চলতে পারি । রমজানের শেষ ১০ দিনের ইবাদত ও করণীয় রামজান গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার মাস ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশি থাকে এ মাসে। এ মাসে  প্রতিটি কাজেই রয়েছে গুনাহ মাফের হাতছানি। নিয়মিত ইবাদতের পাশাপাশি এ মাসের সেহরি খাওয়া, সময় মতো ইফতার করা, মসজিদে জামাতে তারাবি নামাজ পড়া, তাহাজ্জুদ পড়া, নফল নামাজ পড়া, গভীর রাতে কোরআন তেলাওয়াত করা, বিতর নামাজ পড়া এবং শেষ রাতে সেহরি খেয়ে রোজার নিয়ত করে ফজরের নামাজ জামাতে পড়ার মাধ্যমে গুনাহ থেকে মুক্তির চেষ্টা করা। রমজানের প্রতিটি মুহূর্তের আমলেই মহান আল্লাহ বান্দাে ক্ষমা করেন, বদ আমল থেকে মুক্তি দেন। রমজানের শেষ দশকে নাজাত বা গুনাহ থেকে মুক্তির সুযোগ সবচেয়ে বেশি। কী সেই সব সুযোগ?

যারা মর্যাদার মাস রমজান পেলো অথচ নিজেদের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব ব্যক্তি ও রোজাদারদের জন্য অভিশাপ দিয়েছেন। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত কায়াব বিন ওজরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমিন বলার কারণ বর্ণনা করে) বলেন, ‘এ মাত্র হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম (এসে ৩টি ঘোষণা দিয়ে)  বললেন-

> (প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই জিবরিল বলল) ধ্বংসহোক সে ব্যক্তি; যে রমজান মাস পেলো অথচ তার গুনাহ মাফ করাতে পারলো না। আমি বললাম, আমিন। (নাউজুবিল্লাহ)

> (দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখতেই জিবরিল বলল) ধ্বংসহোক সে ব্যক্তি; যার সামনে আপনার নাম উচ্ছারিত হওয়া সত্ত্বেও সে আপনার ওপর দরূদ পড়েনি। আমি বললাম, আমিন। (নাউজুবিল্লাহ)

> (তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখতেই জিবরিল বলল) ধ্বংসহোক সে ব্যক্তি; যে তার বাবা-মা উভয়কে অথবা উভয়ের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেলো অথচ সে জান্নাত অর্জন করতে পারলো না। আমি বললাম, আমিন। অর্থা আল্লাহ কবুল করুন।’ (মিশকাত)

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদিস থেকে প্রমাণিত, রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতের মাস। ইতিমধ্যে রহমত ও ক্ষমার দশক পেরিয়ে রমজানের শেষ দশক তথা নাজাত ও ইতেকাফের দশকে অবস্থান করছে মুসলিম উম্মাহ। এ দশকে ক্ষমা ও নাজাতের বিকল্প নেই। নতুবা প্রত্যেকের জন্য অপেক্ষা করছে নবিজীর অভিশাপ।

সুতরাং রমজানের শেষ দশকে প্রত্যেক ঈমানদার রোজাদারের উচিত, বাকি ১০ দিন যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে রমজানের শেষ দশক অতিবাহিত করা। সম্ভব হলে আজই ইতেকাফে বসে যাওয়া। যথাসময়ে হাদিসে ঘোষিত কাজগুলোর প্রতি মনোযোগী হয়ে নবিজীর অভিশাপ ও নিজেদের গুনাহ থেকে মুক্তির শেষ প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া।

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য আশার বাণী শুনিয়েছেন এভাবে-

‘রমজান মাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে আটক করে রাখা হয়।’ তাই রমজানের ইবাদত-বন্দেগিগুলো আরাম ও নির্ভেজালভাবে করা যায়। সুতরাং প্রত্যেক রোজাদারের উচিত এ কাজগুলো করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা-

২.  হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, যার জীবনে রামজান মাস এলো, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না।’ (তিরমিজি)

একবার জুমার খুতবা দিতে মিম্বারে ওঠার সময় নবিজী প্রথম সিড়ি পা রেখে বললেন, আমিন; দ্বিতীয় সিড়িতে পারে রেখে বললেন, আমিন; তৃতীয় সিড়িতে পা রেখেও বললেন, আমিন। এমনটি তিনি এর আগে কখনো করেননি। কেন তিনি তিন বার আমিন বললেন? এ কৌতুহল কাজ করছিল সাহাবায়ে কেরামের মনে। পরে তিনি বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেন-

১. সম্ভব হলে ওমরা করা। কারণ রমজানে ওমরা করা ফরজ হজের সমান সাওয়াব পাওয়া যায়।

২. বরকতের নিয়তে শেষ রাতে অল্প হলেও সেহরি খাওয়া। তাতে রয়েছে অকল্পনীয় বরকত।

৩. সেহরি খেয়ে রোজার নিয়ত করা এবং কোরআন তেলাওয়াত করা।

৪. ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা।

৫. সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। ইফতারেও রয়েছে গুনাহ মাফ ও অকল্পনীয় কল্যাণ।

৬. অন্যদের ইফতার করানো।

৭. ইফতারের সময় তাওবা-ইসতেগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।

৮. তারাবি নামাজ জামাতে আদায় করা। তারাবির নামাজে রয়েছে সারারাত নামাজ পড়ার সওয়াব।

৯. তারাবির পর নফল নামাজ পড়া।

১০. গভীর রাতে কোরআন তেলাওয়াত করা এবং আল্লাহর কাছে গুনাহের জন্য কান্না-কাটি করা।

১১. শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া। নামাজের সেজদায় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

১২. সেহরির আগে বিতর নামাজ পড়া। আল্লাহর কাছে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে শেখানো দোয়াটি বেশি বেশি পড়া-

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)

১৩. কম হোক আর বেশি হোক সেহরি খাওয়া।

রমজানের পুরো মাসের মধ্যে শেষ ১০ দিনের তাৎপর্য অনেক বেশি। কারণ শেষ দশকের প্রত্যেকটি ইবাদতকে আল্লাহ উদারভাবে দেখেন এবং অনেক বেশি সওয়াব দান করনে। আর এ দশকেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ একটি রাত ‘লাইলাতুল কদর’। আল্লাহ তাআলা নিজেই এ ঘোষণা দেন-

‘নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমারা কি জানো, ‘লাইলাতুল কদর’ কী? লাইলাতুল কদর হলো- হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরিল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত (কল্যাণ) নিয়ে (জমিনে) অবতরণ করেন। শান্তিময় সে রাত ফজরের উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত।’ (সুরা কদর : আয়াত ১-৫)

লাইলাতুল কদর তালাশের নির্দেশ

কোরআনের এ দিকনির্দেশনার কারণেই নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানে লাইলাতুল কদর তালাশ করার কথা বলেছেন। শেষ দশকে ইতেকাফ করতে বলেছেন। ইবাদত-বন্দেগির ধরণ কেমন হবে সে দিকনির্দেশনা ও জোর তাগিদ দিয়েছেন। হাদিসে পাকে এসেছে-

১. অন্য বর্ণনায় আরও সুস্পষ্ট করে বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বে-জোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি)

২. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ”তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর খোঁজ করো।’ (বুখারি)

৩. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, যখন রমজানের শেষ দশক উপস্থিত হতো; নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন; রাত জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে তুলতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

৪. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আরও বলেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এমন মুজাহাদা করতেন; যা তিনি অন্য মাসে করতেন না।’ (মুসলিম)

৫. হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে নিজ পরিবারকে জাগ্রত করতেন।’ (তিরমিজি)

উল্লেখ্য, আল্লাহ তাআলা নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগের পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার পরও তিনি তাওবা-ইসতেগফার এবং ইবাদত-বন্দেগিতে কল্পনাহীন পরিশ্রম করতেন। এমনকি তিনি রমজানের শেষ দশকে স্ত্রীদের সঙ্গও ত্যাগ করতেন। নিজ পরিবার ও তাঁর উম্মতকে রাতের ইবাদতের জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতেন।

লাইলাতুল কদরে গুনাহ মাফ

হাজার মাসের চেয়ে উত্তম একটি রাত লাইলাতুল কদর। এই রাতের ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদাতের সমান। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

১. ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের রাতে বিশ্বাস ও পুরস্কারের আশায় ইবাদাতরত অবস্থায় থাকবে, আল্লাহ তাআলা তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (বুখারি)

২. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে মসজিদে ইতেকাফ করতেন। যতদিন না আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেছেন ততদিন পর্যন্ত তিনি এ আমল অব্যাহত রেখেছিলেন। তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীগণও ইতেকাফ করেছেন।’ (বুখারি)

৩. হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইতেকাফকারী যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত থাকেন এবং তার জন্য ওই পরিমাণ নেকি লেখা হয়, যে পরিমাণ আমলকারীর জন্য লেখা হয়ে থাকে।’ (মেশকাত)

মুসলিম উম্মাহর সব রোজাদারের জন্য রমজানের শেষ দশক ও ইতেকাফ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই দশকে প্রত্যেকেই ইবাদতে নিজেদের নিয়োজিত রাখা। নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ও তাওবা-ইসতেগফার করা। আল্লাহর কাছে নিজেদের গুনাহ মাফে কান্নাকাটি রোনাজারি করা। আর তাতেই মিলবে গুনাহ থেকে ক্ষমা এবং কল্যাণ।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব রোজাদারকে রমজানের শেষ দশকের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকার তাওফিক দান করুন। গুনাহমুক্ত জীবন পাওয়ার তাওফিক দান করুন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

thirteen − three =