ঘুষের স্বর্গরাজ্য কেরানীগঞ্জ ভূমি অফিস

0
728

১) ই-নামজারী করতে লাগে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। 

২) ভূমি উন্নয়ন কর রশিদের বাহিরে অতিরিক্ত অর্থ আদায় 

৩) দুর্নীতিতে জড়িত খোদ অফিস কর্মকর্তা

৪) কর্মকর্তা ও দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে জিম্মি সেবাপ্রত্যাশীরা

৫) মিসকেসের রায় মিলে টাকায়। 

মোঃ আহসানউল্লাহ হাসানঃ

সরকারের নির্ধারিত ফি অনুযায়ী জমির নামজারি করতে লাগে ১১৭০ টাকা। কিন্তু এই অফিসগুলোতে ই-নামজারি করতে লাগে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া “খ” তালিকাভূক্ত জমির নামজারির ক্ষেত্রে খচর পরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ভুতুড়ে এ খরচের অনুসন্ধানে উঠে আসে নানান তথ্য। যেখানে অনিয়ম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলবে কোত্থেকে। এমন চিত্র ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ভূমি অফিস ও তহশীল অফিসগুলোতে। সরকারি আইনের ভিত্তিতে ভিটেমাটি রক্ষায় প্রাচীনকাল থেকে কাঙ্খিত সেবা প্রত্যাশীদের দারস্থ হতে হয় ইউনিয়ন তহশীল অফিস ও ভূমি অফিসগুলোতে। তবে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ভোগান্তিহীন সেবা পেতে ঘুরতে হয় টেবিলে টেবিলে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অফিসগুলো জিম্মি হয়ে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। যেখানে টাকা ছাড়া নড়ে না ফাইল, মিলেনা কাঙ্খিত সেবা।  

সেবা প্রাপ্তির ৮০ শতাংশ লোকই চরম হয়রানির শিকার হতে হয় আজ না-কাল সময়ক্ষেপণ করে। সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত হারে দাবিকৃত উৎকোচ না দিলে সেবা গ্রহীতারা পান না তাদের কাঙ্খিত সেবা। এছাড়া মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হয় উপজেলা ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন স্তরে ভাগ দেয়ার কথা বলে। 

এছাড়াও জমির নবায়ন ফি, ভূমি উন্নয়ন কর ও মিস কেস করতে সরকার নির্ধারিত ফি এর কয়েকগুন বেশী অর্থ না দিলে কাজ হয়না বলে জানান সেবা গ্রহীতারা। তাদের অভিযোগ মিস কেস তদন্তের জন্য কোন কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে তাকে যাতায়াত ও চা-নাস্তা খরচ বাবদ দুই থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। তদন্ত শেষে প্রতিবেদনের জন্য দিতে হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। আর উপজেলা ভূমি অফিসে রিপোর্ট গেলে টাকার বিনিময়ের মিস কেসের রায় এনে দেওয়ার চুক্তি করেন অফিসটির নাজির ও মিসকেস সহকারী আনোয়ার হোসেন এবং রায়ের জন্য জমি বেধে টাকা নির্ধারণও করে দেন তিনি অভিযোগ ভূক্তভোগীদের। 

এদিকে সংস্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে অফিস পরিচালনা হচ্ছে অভিযোগ ভূক্তভোগীদের। সরেজমিনে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে জানা গেলো সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সংখ্যা পাঁচ জন। কিন্তু অফিসটিতে দেখা গেলো ১০ থেকে ১২ জন যুবক চেয়ার টেবিল নিয়ে কাজ করছেন। বহিরাগতদের দখলে অফিসের রেকর্ডরুম। নাড়াচারা করছেন গোপন নথীপত্রও। আর ভূমি অফিসে আসা সেবা গ্রহীতারাও কাগজপত্র নিয়ে তাদের পিছেই ছুটছেন। সেবা গ্রাহীতারা জানান- নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর, মিস কেসসহ সব কিছুতেই ঘুষ দিতে হয় তাদের। সরকারি ফি থেকে বেশি টাকা না দিলে কাজ হয় না এখানে।   

অন্যদিকে সরকারি ওয়েবসাইট নকল করে ভুয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে এই অফিসটিতে। তাছাড়া উপজেলা ভূমি অফিসের নামজারী সহকারীর সোহেল রানার টেবিলে আর্থিক লেনদেনের দৃশ্যও ধরা পরে প্রতিবেদকের ক্যামেরায়। আইন না মেনে বহিরাগতদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ন্য কাজও করাচ্ছেন তিনি। যে কম্পিউটারটি তার চালানোর কথা সেটি চালাচ্ছেন অন্যকেউ। খোজ নিয়ে জানা গেলো সোহেল রানার কম্পিউটারটি যিনি অপারেটর করছেন তিনি সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ নয়।   

কোন্ডা ইউনিয়নের বাসিন্দা মোঃ এসবার হোসেন সারোয়ার জানান, শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা আফরোজা খাতুন ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ তার কাছে নয় হাজার টাকা দাবি করেন। পরে তিনি সাত হাজার টাকা দিলে। ভূমি কর্মকর্তা আফরোজা খাতুন তাকে রশিদ দেন ৪ হাজার সাতশ বিরাশি টাকার। এর আগেও অফিসটির ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রনজিত চন্দ্র নাথ অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কম টাকার রশিদ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ এই ভূক্তভোগীর। তিনি আরো জানান, সরকারি ফি থেকে বেশি টাকা না দিলে কাজ হয় না এখানে। বেশি টাকা কেন দিব বলতে গেলে দুর্ব্যবহার করে অফিস থেকে বের করে দেন।  

আরেক ভূক্তভোগী শুভাঢ্যা ইউনিয়নের কালিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মোঃ গোলাম হাসান জানান, নিজের নামজারি নিজে করতে গেলে এটা নাই সেটা নাই বলে নামজারি বাতিল করে দেন। তাই বাধ্য হয়ে লোক ধরতে হয়। এতে নামজারি করতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লেগে যায়। তিনি জানান, তার নিজের নামে নামজারির আবেদন করে নথি জমা দেওয়ার পর শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে তার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বন্টন নামা দলিল নিয়ে দেখা করতে বলেন। পরে দলিল নিয়ে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রনজিত চন্দ্র নাথ এর সাথে দেখা করলে তার আবেদনটি বাতিল হয়েছে বলে নতুন করে পুনরায় আবেদন করতে বলেন। ২য় বার আবেদন করে অফিসে যাওয়ার পর ভূমি কর্মকর্তা রনজিত চন্দ্র নাথ তার সহকারী ইমরানের সাথে কথা বলতে বলেন। তার কাছে গেলে তিনি জানান রিপোর্ট নিতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা খচর লাগে। তাই এক হাজার টাকা দিতে হবে। টাকা কেনো দিতে হবে জানতে চাওয়া হলে ইমরান বলেন তাদের বেতন নেই। তাই চা-নাস্তা ও অফিস খচর বাবদ এটা দিতে হবে। পরে তিনি টাকা দেওয়ার পর বন্টননামা দলিল ছাড়াই নথি উপজেলা ভূমি অফিসে পাঠানো হয়। ভুক্তভোগীর অভিযোগ টাকা দিলে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। আর না দিলে নতুন করে একটার পর একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই অফিসে হোল্ডিং খোলার জন্যও দিতে হয় দুইশ টাকা, একটা খসড়া তুলতে গেলেও দিতে হয় একশ থেকে দুইশ টাকা। নামজারি করার পর ভূমি উন্নয়ন কর দিতে গেলে এক কর্মকর্তা বলেন ছয় হাজার টাকা আরেকজন বলেন ছাব্বিশ হাজার টাকা। পরে তার কাছ থেকে সঠিক ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ রাখা হয়েছে পাঁচ হাজার একশ পঞ্চাশ টাকা। 

সেবা প্রত্যাশী মোঃ মালেক নামে এক ভূক্তভোগী বলেন, “মিস কেসের রায়ের জন্য উপজেলার দক্ষিণের ভূমি অফিসের নাজির ও মিস কেস সহকারী আনোয়ার স্যার আমার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা চেয়েছে। আমি গরিব মানুষ তিন হাজার টাকা দিয়েছি বাকি টাকার জন্য কাজটি আটকে রেখেছে।”  

আরেক ভূক্তভোগী জানান, সব কিছু ঠিক থাকার পরও টাকা না দেওয়ায় তার নামজারিটি আটকে ছিলো অথচ যারা টাকা দিয়েছে সবার নামজারি হাতে পেয়েছে।   

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা আফরোজা খাতুন কোন বক্তব্য দেননি। 

তবে ঘুষ লেনদেনে কথা অস্বীকার করে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রনজিৎ চন্দ্র নাথ জানান, অফিসটিতে অতিরিক্ত দালাল থাকার কারণে কে প্রকৃত সেবা গ্রহীতা আর কে দালাল সেটি আলাদা করা সম্ভব হচ্ছে না। আর অতিরিক্ত টাকা দালালরা নিচ্ছে দাবি করে তিনি জানান, জনবল সংকটের কারণে তার অফিসে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বাহিরেও অতিরিক্ত দুই-তিন জন লোক কাজ করছেন। এছাড়া দুইজন কম্পিউটার অপারেটরকে নিজেদের বেতন থেকে প্রতিদিন পাঁচশ থেকে ছয়শ টাকা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এই ভূমি কর্মকর্তা। সরকারি ওয়েবসাইট নকল করে ভুয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, দীর্ঘদিন তার অফিসে কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে যিনি কাজ করতেন। তিনি সরকারি ওয়েবসাইটের আদলে হুবহুব ওয়েবসাইট নকল করে ভুয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করে অনলাইন থেকে রশিদ প্রদান করেন। বিষয়টি ধরা পরার পর তাকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১৫ দিনের জেল দেওয়া হয়। বর্তমানে সে জেলে আছে।    

কেরানীগঞ্জ দক্ষিণের উপজেলা ভূমি অফিসের নামজারী সহকারী সোহেল রানার সাথে একাদিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।    

এ ব্যাপারে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ আবু রিয়াদ এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। 

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মেহেদী হাসান বলেন, কেরানীগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি ভূমি অফিসকে দালাল মুক্ত করার পাশাপাশি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তকরে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা আছেন প্রত্যেকের আইডি কার্ড থাকবে। এর বাহিরে বহিরাগত কোন লোক অফিসে কাজ করতে পারবে না।   

ঘুষ, হয়রানি ও দালাল ছাড়াই যেনো নিজের কাজ নিজেই করতে পারেন এবং দুর্নীতির এই বেড়া ভেঙে ভোগান্তিহীন নাগরিকসেবা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপের দাবি ভূক্তভোগীদের।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 + eleven =