শিল্পমন্ত্রীর আসনে হাট-বাজার চান্দিনা ভিটি বন্দোবস্তায় মানা হয়নি ভূমি আইন একাধিক অভিযোগের পরেও নির্বিকার প্রশাসন

0
793

মোল্লা নাসির উদ্দিন: শিল্পমন্ত্রীর সংসদীয় আসন (নরসিংদী-৪) বেলাব-মনোহরদীর বেলাবতে সরকারী পেরিফেরিভূক্ত হাট-বাজারের চান্দিনা ভিটির বন্দোবস্তায় মানা হয়নি ভূমি বন্দোবস্তা আইন। প্রশাসনের সেচ্ছাচারিতায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আইনের ধারা ও বর্তমান সরকার এর শাসন ব্যবস্থা। ইউএনও ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর এরকম ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), ভূমি মন্ত্রনালয় ও জনপ্রশাসনে একাধিক অভিযোগ করেও তেমন কোনো সাড়া পায়নি ভুক্তভোগীরা। প্রসঙ্গত, সরকারী খাস জমি বন্দোবস্তা করার জন্য সরকার হাট ও বাজার (স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা) আইন ২০১৮ নামে একটি বিধিমালা প্রনয়ন করেন যা হাট-বাজার আইন ২০১৮ নামে পরিচিত। সরকার এ আইনের মাধ্যমে সারাদেশে বাজারের সারকারী খাসজমিকে একটি পেরিফেরিভূক্ত ম্যাপ করে চান্দিনা ভিটি, তোহা বাজার, কসাইখানা ইত্যাদি নামে সুস্পষ্ট করে  অস্থায়ী বন্দোবস্তার জন্য একসনা বন্দোবস্তার প্রচলন করেন। যার মেয়াদ থাকবে বরাদ্দপ্রাপ্তির তারিখ থেকে এক বছর। এ আইনে কৃষক বা বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অস্থায়ীভাবে ব্যাবসা পরিচালনা করবে। এ আইনের বিধি-৬ এ কিছু শর্ত উল্যেখ করে বিধিমালা করা হয়। বিধি-৬ এ উল্যেখ করা হয়েছে যে, হাট-বাজারের কোনো জমি স্থায়ী বন্দোবস্তা করা যাবে না, একজন প্রকৃত ব্যবসায়ীকে সর্বোচ্চ অর্ধ-শতক জমি একসনা বন্দোবস্তা করতে পারবে। বরাদ্দকৃত জমি কোনো সাবলীজ, ভাড়া প্রদান ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না, বরাদ্দপ্রাপ্ত জমিতে কোনো পাকা, আধা-পাকা অবকাঠামো নির্মানের অনুমতি প্রদান করা যাবে না, বরাদ্দকৃত ভিটিতে করা যাবে না কোনো স্থায়ী স্থাপনা।

কিন্তু ১৫ই মার্চ ২০২২ ইং তারিখে নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার বেলাব বাজারে একসনা বন্দোবস্তার মাধ্যমে যে ১৯টি ভিটি বন্দোবস্তা করা হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে হাট-বাজার (স্থাপনা ও বন্দোবস্ত) আইন ২০১৮ এর সাথে অসংগতিপূর্ণ। এখানে বন্দোবস্তার মাধ্যমে বাজারের প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করে সচ্ছল, বড় ও অপ্রকৃত ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাই গত ২২-০৬-২০২২ইং তারিখে বাজারের একজন সুবিধা বঞ্চিত ব্যবসায়ী মো: বোরহান উদ্দিন দুদক, ভূমি মন্ত্রনালয় সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় সচিব, জেলা প্রশাসক, নরসিংদী বরাবর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দাখিল করেন।

অভিযোগে বোরহান উদ্দিন বলেন, তারা প্রায় ২০-২৫ বছর যাবৎ এ বাজারে ভূমিহীন ও অসচ্ছল ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যবসা করে আসছে। উপজেলা ভূমি অফিস থেকে বাজারের উক্ত অংশে একসনা বন্দোবস্তার মাধ্যমে চান্দিনা ভিটি বরাদ্দ করা হবে খবর পেয়ে বাজারের প্রকৃত ব্যবসায়ী বোরহান, আরমান সহ আরো অনেকে কাগজপত্র সহ আবেদন জমা দিতে গেলে ভূমি অফিস থেকে তাদের কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হয়। বোরহান আরো বলেন, ইউএনও ও এসিল্যান্ড প্রতি ভিটি ২.৫ লাখ টাকা করে নিয়ে বাজারের অপ্রকৃত, সচ্ছল ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কাছে বরাদ্দ দেন। এখানে ১৯টি ভিটি বরাদ্দের মাধ্যমে প্রায় অর্ধ-কোটি টাকা বাণিজ্য করে প্রশাসন। এছাড়াও যারা চান্দিনা ভিটি বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের মধ্যে ১। রাহুল কুদ্দুস, বাজারের একজন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার ও কোটি টাকার সম্পদের মালিক, ২। রুহুল আমীন, তিনিও প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার ৩। নজরুল ইসলাম, গ্র্যান্ড নবাব নামে একটি রেস্টুরেন্ট এর মালিক ৪। সোহেল একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, ৫। রুবেল, বাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তারা প্রত্যেকে ২টি করে ভিটি বরাদ্দ নিয়েছেন। তাছাড়া শাহিন, সুরুজ মিয়া, জসিম তারা ১টি করে ভিটি বরাদ্দ পেয়েছে যা হাট-বাজার বন্দোবস্ত আইনের পরিপন্থি। বরাদ্দপ্রাপ্তদের অনেকেই বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।

তাছাড়া বরাদ্দ পাওয়ার সাথে সাথে তারা একসনা লীজের মাধ্যমে প্রাপ্ত ভিটিতে ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ীভাবে বিল্ডিং তোলার কাজ শুরু করে প্রায় সমাপ্ত করে ফেলেছে। সে সকল স্থায়ী স্থাপনা বরাদ্দকৃত ভূমিতে এখনো বর্তমান। বরাদ্ধপ্রাপ্ত সবাই চারপাশ ইটের দেওয়াল তৈরি বরে মাঝখানে আরসিসি পিলার দিয়ে স্থায়ীভাবে নির্মান করছে স্থাপনা। যা হাট-বাজার স্থাপনা ও বন্দোবস্ত আইন-২০১৮ এর সম্পূর্ন পরিপন্থি ও সাংঘর্ষিক। 

অভিযোগে বোরহান আরো বলেন, কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়া ইউএনওর নির্দেশে এসিল্যান্ড শাহিনুর আক্তার ২১-০৬-২০২২ইং তারিখ সকালে এসে সকল স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার আদেশ দিলে বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যাক্তিরা তাদের দলবল নিয়ে সকল স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলে এতে উক্ত জায়গায় থাকা ব্যবসায়ীদের প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্যেখ করা হয়।

বেলাব বাজারের চান্দিনা ভিটি বরাদ্দপ্রাপ্ত বিএনপির নেতা কুদ্দুস ভূইয়ার ছেলে জসিম বলেন তারা প্রশাসনের নির্দেশেই স্থায়ীভাবে নির্মান করেছে। তারা বাজারের প্রকৃত ব্যবসায়ী না হয়েও কিভাবে ভিটি পেলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেন নি। তারা জানে এগুলো ৯৯ বছরের জন্য বরাদ্দ। তাই তারা স্থায়ীভাবে স্থাপনা নির্মান করেছে।

বরাদ্দপ্রাপ্ত সোহেল বলেন, বেলাব বাজারের চান্দিনা ভিটি বন্দোবস্তায় তারা প্রত্যেকে ২.৫ লাখ টাকা প্রশাসনকে দিতে হয়েছে। সোহেলও একাধিক ভিটি বরাদ্দ পেয়েছে। তাছাড়া বাজারের প্রকৃত ব্যাবসায়ীদের দাবী প্রশাসন টাকার বিনিময়ে বাজারের বড় বড় ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে সরকারী ভিটি বিক্রি করে দিয়েছে। আমাদের কছে টাকা নেই বলেই আজ আমরা ভিটি বঞ্চিত। সরকার এ ভিটি আমাদের মত ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দ দিলেও টাকার কাছে আমরা হেরে গেলাম। তারা বলেন, আমরা কার কাছে অভিযোগ করবো, আর অভিযোগ করেই বা কি লাভ। কে শুনবে আমাদের কথা। যেখানে সরকারের লোকই সরকারী আইন মানে না সেখানে আমাদের মতো ছা-পোষারা কি বলবো। আমাদের বলার কিছুই নেই তবে বিচার একদিন হবেই হবে। কারন পাকিস্তানীরাও অত্যাচার করে রক্ষা পায়নি, আজকের প্রশাসন ও প্রশাসনের দালালরাও রক্ষা পাবে না। এদেশেই তাদের বিচার হবে। তাছাড়া শিল্পমন্ত্রীর নিরবতা সাধারন জনতার মনে আরো প্রশ্ন তুলছে। এতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশের শাসন ব্যবস্থা, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সরকার, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়া বেলাব উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে উপজেলার দুলালকান্দি বাজারে সরকারী খাসজমিতে থাকা পেরিফেরিভূক্ত ১০১টি ভিটি বন্দোবস্তা করার সময় প্রায় ২ কোটি টাকার বাণ্যিজ্য করেছে বলে দুদকে ২৫-০৮-২০২১ইং ও ২৮-০৩-২০২২ইং তারিখে পৃথক পৃথক ২টি অভিযোগ করেন দুলালকান্দি বাজারের লীজ বঞ্চিত ২৫ বছরের পুরাতন ব্যবসায়ী ফিরোজ মিয়া। সেখানে প্রতি ভিটি ১ লাখ ১০ হাজার করে টাকা নিয়ে উপজেলা প্রশাসন চান্দিনা ভিটি বন্দোবস্তা করে বলে উল্যেখ করা হয়। দুলালকান্দি বাজরের ১০১টি ভিটি নেতা, ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক, ভূমি অফিসের ঝাড়ুদার, পুলিশসহ বাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে টাকার মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাদের অনেকে আবার অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে দ্বিগুণ, তিনগুন দামে বিক্রি করে দেয় যা আইনের পরিপন্থি।

এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহিনুর আক্তার এই প্রতিবেদককে বলেন, বেলাব বাজারে অন্যান্য ভিটি যেভাবে নির্মান করেছে এগুলো সেরকম ভাবেই নির্মান করা হবে। একসনা বন্দোবস্তায় এরকম স্থায়ী স্থাপনা নির্মান অবৈধ ও আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এছাড়া গত ০৫-০৬-২০২১ইং তারিখে বর্তমান ইউএনওর নির্দেশে উপজেলা চত্ত্বর থেকে কোনো রকম নোটিশ ছাড়া ১০-১১ টি গাছ কর্তন করে বিক্রি করা হয়। যা সরকারের বন আইনের পরিপন্থি। এ জন্য বেলাব উপজেলা থেকে আনিস মিয়া নামে এক ব্যক্তি বনবিভাগ অভিযোগ করেও তেমন কোনো ফল পাননি এ বিষয়ে উপজেলা নির্বিহী অফিসার আক্তার হোসেন শাহিন বলেন, আমরা আইন বহির্ভূত কোনো কাজ করিনি। চান্দিনা ভিটিতে স্থায়ী স্থাপনা নির্মানের বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five × 2 =