তিরটা নিজেদের দিকেই তাক করছি। বলছি, আমাদের মধ্যে অনেকেই খুব ভালো সাংবাদিকতা করছেন না। করতে পারছেন না। আরও চাঁছাছোলাভাবে বললে, সুসাংবাদিকতা থেকে অনেকে অনেক দূরে। কারণ, একপক্ষীয় বিবরণ আর যা-ই হোক, সাংবাদিকতা নয়। তথ্যকে বিনা চ্যালেঞ্জে পাঠকের সামনে পরিবেশন করা সাংবাদিকতার নীতি অনুমোদন করে না। কিন্তু বাংলাদেশে এই চর্চা দিনের পর দিন লক্ষ করা যাচ্ছে। কথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় সম্পর্কে গা-ছাড়াভাবে সংবাদ পরিবেশনের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে বলছে, সাংবাদিকদের অনেকে মাছি মারা কেরানির মতো ঘটনার বিবরণ সেভাবেই তুলে ধরছেন। স্থান-কাল-পাত্র ছাড়া গল্প এক। পরিণতিও এক। ব্যাপারটা যেন ডাল-ভাত। সব জেনে-শুনে-বুঝে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেওয়ার মতো একটা পরিস্থিতি সাংবাদিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে, ক্রসফায়ার চলছে, চলবে। এ নিয়ে আর কিছু করার নেই। তাই সংবাদ পরিবেশনে যত অযত্ন, দায়িত্বহীনতা! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ক্রসফায়ারের সংবাদ পরিবেশনের মতো সহজ কাজটি বোধ হয় আর নেই। গল্প তো মুখস্থই। সংবাদ লেখার ছকও মাথায় সাজানো। পুলিশ-র্যাবের বক্তব্য পেলেই হয়। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে সংবাদ তৈরি। কোনো প্রশ্ন নেই। কোনো সন্দেহ নেই। যেনতেনভাবে পত্রিকার এক কোণে ছেপে দিলেই কাজ শেষ। কত্ত সহজ সাংবাদিকতা! সাংবাদিকেরা বেশ কৌশলী। লোকে কি-না-কি বলে! সমালোচিত হওয়ার সুযোগ আছে কি না—এসব ভাবনা মাথায় থাকে। সমালোচনার সুযোগ দেওয়া যাবে না। তাই আত্মরক্ষার একটা কায়দা বের করা হয়েছে। কথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময়—এসব শব্দকে বিশেষ বন্ধনীতে আটকে দেওয়া হয়। এভাবেই শেষ করা হয় সাংবাদিকতার দায়-দায়িত্ব। ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘গুলিবিনিময়’—এভাবে লিখলে কজন পাঠক এর মানে বোঝে, তা কি কখনো যাচাই করা হয়েছে? শব্দটিকে এভাবে বিশেষায়িত করে কী বোঝানো হচ্ছে, আর পাঠকই-বা কী বোঝেন, তা নিয়ে খুব কমই চিন্তাভাবনা হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হয়। কোট-আনকোট, দাবি, ভাষ্য—এসব কৌশল দিয়ে পার পাওয়ার উপায় কি সাংবাদিকদের আছে? এ নিয়ে ভাবতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবরগুলো পড়লেই বোঝা যায়, সাংবাদিকেরা তথ্য সংগ্রহের সময় যথেষ্ট প্রশ্ন করেন না। নিবিড় অনুসন্ধান তো দূরস্থ!
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদনে ভুক্তভোগী থাকে বরাবরই প্রান্তিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যের ভিত্তিতে সাংবাদিকেরা নিহত ব্যক্তির কথিত সব অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেন। যথারীতি বিবরণে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি হওয়া এবং তারপর আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ার কাহিনি। বিবরণ পড়ে পাঠকের মনে হয়, ‘উচিত সাজাই হয়েছে।’ অন্যদিকে, নিহত ব্যক্তির স্বজনদের বক্তব্য প্রতিবেদনে তেমন আসে না। যা আসে, তা দায়সারা গোছের। সাংবাদিকতার জন্য এই প্রবণতা এক অশনিসংকেত। এটা সাংবাদিকতার নীতির বরখেলাপ। পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীর প্রতি অবিচারও। দেশে আইন-আদালত আছে। অপরাধীর বিচার করা আদালতের কাজ। কিন্তু আদালতের বাইরে সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিচার ও সাজা কার্যকর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বেআইনি, ন্যায়বিচারের চরম লঙ্ঘন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবর পরিবেশন করতে গিয়ে পেশার সুবাদে সাংবাদিকেরাও অপরাধী হয়ে যাচ্ছেন। সব বোঝার পরও প্রশ্ন না তোলা তো অপরাধেরই শামিল। কথিত ক্রসফায়ারের পর সংবাদমাধ্যমে যথারীতি খবর আসে। সাংবাদিক ভাবেন, খবর ছাপা হয়েছে, তাঁর দায়িত্ব শেষ। এটা পেশার সঙ্গে প্রতারণা। পলায়নপর এই প্রবণতার মাধ্যমে সাংবাদিকতা নিজেই ক্রসফায়ারে পড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় সাংবাদিকদের হাতেই। সাংবাদিকদের প্রশ্ন তুলতে হবে, অভিযান কেন রাতেই হয়? সন্দেহভাজন আসামিকে সঙ্গে নিয়েই কেন অভিযানে যেতে হয়? অভিযানে কেন শুধু আটক ব্যক্তিই হতাহত হন? কথিত ওত পেতে থাকা হামলাকারীরা কেন ধরাশায়ী হয় না? সম্ভাব্য হামলার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অভিযানকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন যথেষ্ট প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় না?
এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা সাংবাদিকদের অবশ্যকর্তব্য। সত্য উন্মোচন তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব।
সাইফুল সামিন: সাংবাদিক