হোমিও সেক্টরের মাফিয়া রাজ্জাকের প্রতারণার যত কৌশল
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
সামাজিক পরিচয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার। পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত। পরবর্তী পরিচয়কে পুঁজি করেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে হোমিও সেক্টরে গড়ে তুলেছিলেন প্রতারণার ফাঁদ। সেখানে আটকা পড়ে অনেকে খুইয়েছেন সর্বস্ব। পাওনা ফেরত চেয়ে ঘুরছেন প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছেন না। বরং ধুরন্ধর প্রতারক এখন বোল পাল্টে অন্তর্র্বতী সরকারের সুহৃদ বনে যাবার প্রচার করছেন। খোয়াব দেখছেন বড় কিছু হবার।
আলোচিত এ ব্যক্তি হলেন আবদুর রাজ্জাক তালুকদার। জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকলেও তার চাকুরির মেয়াদ আছে আর মাত্র কয়েকদিন। তবে চাকুরির পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই হোমিও চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ সুবাদে হোমিও চিকিৎসকদের নিয়ে গড়ে তুলেন ‘হোমিও পেশাজীবী পরিষদ’ বা হোসেপ। আর ঢাল হিসেবে সামনে রাখেন বিগত সরকার আমলে প্রভাবশালী কয়েকজন। পরে তাদের ব্যবহার করেই রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হোপেস হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’। যেটি পরবর্তীতে রাজ্জাক তালুকদারের প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পরিচিতি পায়। এর মধ্যে জাসদ নেতা প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদলকে ‘হোপেস হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’ পরিচালনা পর্ষদ-এর সভাপতি করা হয়। অভিযোগ মতে, কলেজ পরিচালনায় সর্বসর্বা হলেও কৌশলী আবদুর রাজ্জাক বরাবর ছিলেন আবডালে। কাগজে-কলমে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ থাকলে তারা ছিলেন নিধিরাম সর্দার। ওই সময় ডিপ্লোমা ও গ্র্যাজুয়েশন কোর্স সার্টিফিকেটের আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। আবার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের নামেও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। পাশাপাশি কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য বানানোর প্রলোভন দেখিয়েও নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। এভাবে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও তার বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ আমলে নেয়া হয়নি।
ভুক্তভোগীরা জানান, হোপেস কলেজের কার্যক্রম শুরুর আগেই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির অধীনে হোমিওপ্যাথি ফ্যাকাল্টি খুলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়েছেন এবং হাজিরা খাতায় সই নিয়েছেন। ভর্তি ফি সংগ্রহ করেছেন। মাসিক বেতনও নিয়েছেন। পাশাপাশি কমপক্ষে ৩৫ জনের কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছেন শিক্ষক নিয়োগ দিতে। মন্ত্রী, এমপি ও শিক্ষাবিদদের পরিচয় ব্যবহার করে একাধিক সেমিনার করেছেন। এসব সেমিনারের জন্যও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দফায় দফায় চাঁদা নিয়েছেন। মজার বিষয়, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েশনের নামে টাকা নেয়া হলেও রশিদ দেয়া হয়েছে হোপেস প্রতিষ্ঠানের। সেখানে গ্র্যাজুয়েশনের বিষয়টি উল্লেখ নেই। ফলে প্রতারিতদের কোথাও অভিযোগ করার সুযোগ থাকছে না।
ভুক্তভোগীদের একজন হোপেস হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের প্রভাষক চট্টগ্রাম নিবাসী ডা. মোহাম্মদ লোকমান। তিনিও রাজ্জাকের প্রতারণার শিকার। মোটা অংকের টাকা খুইয়ে তা আদায়ে কয়েক বছর ধরেই প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে ঘুরছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনেও লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে প্রতারক রাজ্জাক রয়েছেন ধরা ছোয়ার বাইরে। ডা. লোকমানের বর্ণনানুযায়ী তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হোমিও হাসাপাতালে মেডিক্যাল অফিসার। হোপেস-এর সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে পরিচয়। পরবর্তীতে হোপেস হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু হলে তার অনুরোধেই সেখানে প্রভাষক হিসেবে যোগদানে সম্মত হন। ওই সময় কলেজের উন্নয়নের কথা বলে ডোনেশন হিসেবে মোটা অংকের টাকা বাগিয়ে নেন রাজ্জাক। এমনকি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া কলেও বেতন-ভাতা পাননি। বরং ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে প্রতারনার ফাঁদে ফেলেন। ৮-৯ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা সমিতির নামে বরাদ্দকৃত জমি থেকে প্লট দেয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেন অর্ধ কোটি টাকা। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা সমিতির নামে আদৌ জমি বরাদ্দ না হলেও ভুয়া কাগজ দেখিয়ে প্রতারণা করেছিলেন আবদুর রাজ্জাক। সেখানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। অর্থাৎ নিজের অপকর্ম আড়াল করতেই আবদুর রাজ্জাক কথিত সমিতির একজন সদস্যের সদস্যপদ ডা. লোকমানের নামে আম-মোক্তারনামা দলিল করে দেন। পরে প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে ডা. লোকমান তার পাওনা টাকা ফেরত চান। এ নিয়ে বহু দরবার-সালিশও হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। প্রতারক আবদুর রাজ্জাক উল্টো ভয়ভীতি দেখান। সরকার পরিবর্তন হলেও রাজ্জাকের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। ভুক্তভোগী লোকমান তার পাওনা টাকা আদায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুূদক) সূত্রে জানা গেছে, ধুরন্ধর রাজ্জাক তালুকদারের বিরুদ্ধে ডিপ্লোমা এবং গ্র্যাজুয়েশন কোর্স সার্টিফিকেটের আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে।
অপর দিকে অন্তর্বতী সরকার আবদুর রাজ্জাক তালুকদারকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে চিকিৎসকদের মধ্যে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। রাজ্জাক তালুকদার দাবি করছেন, সরকার তাকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ায় স্বার্থান্বেষী মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। তার দাবির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয় যোগাযোগ করলে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান,আবদুর রাজ্জাক তালুকদারের এ দাবি ভুয়া। তার ব্যাপারে সরকার কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ধরনের অপপ্রচার উদ্দেশ্যমুলক এবং প্রতারণাপূর্ন। চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলে একজন চৌকস অতিরিক্ত সচিবকে অন্তর্র্বতীকালীন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে।