অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে অধ্যাদেশ হচ্ছে না!
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আইনি কাঠামোতে ফেলার খসড়া অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত হচ্ছে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেয়ার পর নানা বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তা এখন পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ে যায়নি বলে সূত্র জানিয়েছে। অধ্যাদেশটি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ধীরে চলো নীতিতে এগুচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ
বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। তবে এটা নিয়ে এখন তার দপ্তরে কাজ হচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা বলেন, অন্য উইং কাজ করছে কিনা তাও তার জানা নেই।
বিষয়টি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এই খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানোর কথা। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এখনো না পাঠানোর ফলে মনে হচ্ছে, এটা সহসা হচ্ছে না।
একাধিক সূত্র মতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আসা এই সরকারের বৈধতা নেয়ার কোনো বিষয় নেই বলে সরকার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এজন্য এ ধরনের কোনো অধ্যাদেশেরও প্রয়োজন নেই বলে মনে করা হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বা বিপ্লবই এই সরকারের বৈধতার ম্যান্ডেট।
সমপ্রতি ‘অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। এটি জারি হলে আদালতে গিয়ে প্রশ্ন তুলে বর্তমান সরকারকে অবৈধ ঘোষণা বা বাতিল করা যাবে না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার দিন পর্যন্ত সরকারের মেয়াদ থাকবে।
এতে বলা হয়, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং সংবিধান বা অন্য কোনো আইন দিয়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহায়তা দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। বিলুপ্ত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই থাকছে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের পদমর্যাদা। উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ পাবেন না ২৫ বছরের কম বয়সীরা। সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে। অধ্যাদেশ কতো দিনের মধ্যে জারি হতে পারে, তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ই আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ৮ই আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হওয়ায় বর্তমানে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা এবং প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টার পদ বলে কিছু নেই। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি ভিত্তি নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য অধ্যাদেশ জারি করা হবে। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
এতে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাদের মতোই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টাদের পদমর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় উপদেষ্টাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও এখন উপদেষ্টাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা বেঁধে দেয়া হচ্ছে না। খসড়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ-সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, যে তারিখে প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, সেই তারিখ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার বহাল থাকবে। এর আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ কী হবে, তা-ও ঠিক করে দেয়া হচ্ছে অধ্যাদেশে।
এ-সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি অস্থায়ী বা সাময়িক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় সরকার কাজ করবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং সংবিধান বা অন্য কোনো আইন দিয়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহায়তা দেবে। ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রণীত অধ্যাদেশ ও কার্যক্রমের বৈধতা’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংবিধান এবং আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়া এবং নতুন সংসদ গঠিত হইবার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তাহার পদের কার্যভার গ্রহণ করিবেন, সেই তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রয়োগকৃত সকল ক্ষমতা, প্রণীত সকল অধ্যাদেশ, বিধিমালা, প্রবিধানমালা, জারিকৃত প্রজ্ঞাপন, প্রদত্ত আদেশ, কৃতকার্য, গৃহীত ব্যবস্থা আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে প্রয়োগকৃত, প্রণীত, জারিকৃত, প্রদত্ত, কৃত এবং গৃহীত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে এবং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষ ইহাদের বৈধতা সম্পর্কে কোনোভাবেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা ইহাদেরকে অবৈধ বা বাতিল করিতে পারিবে না।’
এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের নিয়োগ নিয়ে ত্রুটি থাকলে সে জন্য কোনো কাজ অবৈধ হবে না। এ জন্য কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা দায়েরও করা যাবে না। অধ্যাদেশের খসড়ায় প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলা হয়, বিদ্যমান অন্যান্য আইনে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে কাজ করতে হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতার জন্য প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিতে হবে।
সংবিধান অনুযায়ী, কারও বয়স ২৫ বছর পূর্ণ না হলে তিনি সংসদ সদস্য হতে পারেন না। সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়। অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারে ২৫ বছরের কম বয়সী কেউ প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাবেন না। কোনো আদালত অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করলে, দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না।
এ ছাড়া নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পার না হলেও এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। এ বিষয়ে সম্মত না হলেও প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা ও স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা পদত্যাগ করতে পারবেন। পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে পারবেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর এবং উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা, পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন।