দূর্নীতি

অবৈধ কোম্পানি, ভূয়া ডাক্তার, আর মানহীন ভেজাল ঔষধে চলছে ইউনানি চিকিৎসার নামে প্রতারনা  

নেপথ্যে কি নারী পাচার ও মাদক ব্যাবসা? 

(অনুসন্ধানী প্রতিবেদন : পর্ব ০১) 

কে এ সাদাত, সীমান্ত বাছের : প্রত্যন্ত এলাকার নিরক্ষর দরিদ্র রোগী আর অর্ধ শিক্ষিত বেকার নারী পুরুষদের টার্গেট করে গড়ে উঠেছে ইউনানি  চিকিৎসার নামে একটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান। আশরাফুল  ল্যাবরেটরীজ নামে ঐ প্রতারনামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্ম কান্ড  অনুসন্ধান করতে গিয়ে অপরাধ বিচিত্রার হাতে এসেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। পিরোজপুর জেলার নেসারাবাদ (স্বরুপকাঠী) উপজেলার জলাবাড়ী চৌরাস্তা সংলগ্ন এলাকায় তাদের প্রতিষ্ঠিত একটি চিকিৎসা ও ঔষধ বিপণন কেন্দ্রের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে অপরাধ বিচিত্রার অনুসন্ধানী টিম। 

  সরুপকাঠীর জলাবাড়ীতে ঐ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুরতে সাপ বেড়িয়ে আসছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে রাস্তার পাশে একটি গাছের সাথে আশরাফুল  ল্যাবরেটরীজ প্রাঃ লিমিটেড লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। সেখানে আরও লেখা রয়েছে চিকিৎসা ও ঔষধ বিক্রয় কেন্দ্র। পরিবেশক হিসাবে রিপন চক্রবর্তী ও রিদয় শীল এর নাম রয়েছে। অনুসন্ধানকালে ঐ কেন্দ্রের কথিত চিকিৎসকেরও একটি ভিজিটিং কার্ড অপরাধ বিচিত্রা অনুসন্ধানী টিমের হাতে আসে। তার নাম ডাঃ বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস। তার ভিজিটিং কার্ড অনুযায়ী তিনি হলেন সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তার সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে সে ইতিপূর্বে ঝালকাঠি এলাকায় একটি কেন্দ্রে এক কথিত নারী স্বাস্থকর্মীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এলাকাবাসী বিষয়টি জানতে পারলে জনরোষের মুখে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তারপর বর্তমানে স্বরুপকাঠীর উক্ত ঠিকানায় আস্তানা গড়ে তোলে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ে সে কোনো সনদও দেখাতে পারেনি। কিন্তু তার ভিজিটিং কার্ড এবং  ব্যাবস্থা পত্রে রয়েছে ডিগ্রির ছড়াছড়ি। 

 ঔষধ বিক্রির সাথে জড়িত রিপন চক্রবর্তী ও রিদয় শীলও দেখাতে পারে নি কোনো সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। তারা জানায় একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই নাকি তারা ঔষধ বিক্রি করছে। ঔষধ বিক্রি করার জন্য তাদের কোনো প্রতিষ্ঠানিক সনদ নাই বলেও তারা জানান। পরে ঔষধ বিক্রির অনুমোদন নিয়ে নিবেন বলে তারা জানান। কিভাবে অনুমোদন নিবেন? এ প্রস্নের জবাবে তারা নিরুত্তর। তারা আরও জানান সবকিছুই তাদের হেড অফিসে আছে। হেড অফিস যেভাবে চালায় তারা সেভাবেই চলে তার চেয়ে বেশি কিছু বলতে তারা অপারগতা প্রকাশ করে। অনুসন্ধানী টিমের নজর এখন তাদের কথিত প্রধান কার্যালয়ের দিকে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদক সাক্ষাৎ গ্রহনের জন্য আশরাফুল ল্যাবরেটরীজ এর কথিত এম ডি আশরাফুল ইসলামের মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। তার হোয়াটসঅ্যাপে এস এম এস পাঠানো হলেও তিনি তার কোনো উত্তর দেন নি। অতঃপর আশরাফুল ল্যাবরেটরিজ এর কথিত  প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানায় তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য প্রাপ্তির জন্য অপরাধ বিচিত্রার পক্ষ থেকে ডাকযোগে আবেদন করা হয় । আবেদনপত্র গ্রহন করে প্রাপ্তি স্বীকার রসিদ ফেরত আসলেও চাহিদা অনুযায়ী কোনো বৈধ ডকুমেন্টস তারা আবেদনকারী প্রতিবেদককে সরবারহ করেনি।

 অপরাধ বিচিত্রার অনুসন্ধানী টিমের নিকট থাকা অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিন তথ্য অনুসন্ধানে নামলে বেড়িয়ে আসতে থাকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। অপরাধ বিচিত্রার হাতে থাকা তাদের প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা যশোরের চাচড়া ডালমিল এলাকায় পরিচয় গোপন করে তথ্য অনুসন্ধান চালায় অপরাধ বিচিত্রা টিম। চাচড়া ডালমিল জামে মসজিদের উত্তর পাশে দুই রাস্তার কর্নারে একটি বাড়ির প্রধান ফটকে একটি সাইনবোর্ড। ইহাছাড়াও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রয়েছে মাটি থেকে দেয়ালের উপর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান ও তার এমডি এর গুনকীর্তন মূলক বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত কয়েকটি ব্যানার ও ফেস্টুন। মূলত তাদের কথিত ঔষধ বিক্রি ও বিপণনের জন্য এই অফিসটি ব্যাবহার করা হচ্ছে। প্রধান ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে  চোখে পড়ে একটি দ্বিতল বাড়ি। বাড়ির নিচতলায় সমগ্র এলাকা জুড়ে রয়েছে  রংবেরং এর বিলবোর্ড ও ব্যানার। প্রতারনামূলক সব তথ্যই রয়েছে এখানে। যা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটা একটা প্রতারনামূলক প্রতিষ্ঠান। নিচতলার ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যায় বেশ পরিপাটি রুম। কয়েকজন টেবিলে লেখা লেখির কাজ করছে। একজন আমাদের কাছে জানতে চাইল কাউকে খুঁজছি কিনা? হাকিম আশরাফুল ইসলাম আছেন কি না? জানতে চাওয়া হলে সে জানায় তিনি বাসায় আছেন। এখনো অফিসে আসেননি। আমরা ভিতরে প্রবেশ করার পূর্বেই তাঁর অফিসে উপস্থিত না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হই। চায়ের দোকানে বিভিন্ন জনের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায় বেশ কয়েক বছর পূর্বে আশরাফুল ল্যাবরেটরীজ এর মালিক আশরাফুল ইসলাম লিটন নামে এক লোক বাড়ীটির নিচতলা ভাড়া নিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও ঔষধ বিক্রির ব্যাবসা করে আসছে। এলাকাবাসী শুনেছে তার বাড়ি নাকি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায় কথিত এমডি আশরাফুল ইসলামের নেই কোনো প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তার বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় হলেও বেশ কয়েক বছর পূর্ব থেকেই যশোর শহরের ডালমিল এলাকায় এসে আস্তানা গেড়েছে সে। এলাকার একটি রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করেই সে তার অবৈধ নানান ধরনের ব্যাবসা পরিচালনা করে আসছে বলে সূত্রটি জানায়।  এলাকাবাসী আরো জানায় বিভিন্ন সময় অনেক মহিলাদের প্রশিক্ষণের নামে এখানে নিয়ে আসা হয়। এলাকাবাসীর সন্দেহ ঐ সকল মহিলাদের মাধ্যমে ঔষধ বিক্রির নামে মাদক বেচাকেনা এবং নারী পাচারের মত জঘন্য অপরাধ সংঘটিতও হতে পারে। এলাকাবাসী সূত্রে আরো জানা যায় তাদের ঔষধ তৈরির কারখানা ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জে বলে তারা শুনেছে।

 যশোরের তাদের কথিত প্রধান কার্যালয় থেকে অনেক অপকর্মের তথ্য সংগ্রহ করে অনুসন্ধানী টিমের পরবর্তী গন্তব্য খুলনায় তাদের আরেকটি ঔষধ বিপণন কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। অনুসন্ধানী দলের হাতে থাকা ঠিকানা অনুযায়ী তাদের খুলনার শেরেবাংলা রোড এ পুরাতন নির্বাচন কমিশন ভবনে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায় এখান থেকে তারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে তা কেউই বলতে পারে না। তবে কি তারা পালিয়েছে ? এ প্রস্নের উত্তর অনুসন্ধানে রয়েছে অনুসন্ধানী দল। সাথে সাথে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা    ভোলা, পিরোজপুর, বরিশাল, বাগেরহাটসহ কয়েকটি জায়গায় তাদের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ইতিমধ্যে অপরাধ বিচিত্রার হাতে এসেছে। 

ঐ প্রতিষ্ঠানটি একটি ইউনানি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বলে তাদের প্রচারনা সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু আসলেই কি তারা ঔষধ উৎপাদন করে?  এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে তাদের মূল প্রতারনার জায়গাটি। তাদের ঝিনাইদহে অবস্থিত কথিত কারখানায় নেই কোনো কেমিস্ট। তারা সুন্দর সুন্দর চোখ ধাধানো ঔষধের মোড়ক তৈরি করে ঐ কারখানায় নিয়ে আসে।  তাদের কথিত ঐ কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের মাধ্যমে ভারত থেকে চোরাই পথে আনা কিছু ইউনানি ঔষধের সাথে পানি, চিনি, আদা, রোশনসহ অন্যান্য মশলার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাহা বোতলে ভরে দৃষ্টি নন্দন মোড়কে ঠুকিয়ে তাদের নির্ধারিত এজেন্টদের মাধ্যমে বাজার জাত করা হয়। তাদের ঔষধের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন নামের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, পাউডার এবং সিরাপ জাতীয় নকল ঔষধ। তাদের দেয়া বিজ্ঞাপন অনুযায়ী এর বেশির ভাগই যৌন উদ্দীপক ঔষধ। মানুষকে ভূয়া চিকিৎসা নিতে এবং নকল ঔষধ ক্রয় করতে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য ভূয়া নারী ও পুরুষ চিকিৎসকদের মাধ্যমে ফেইসবুকে পোস্ট দেয়া হয়। ইহাছাড়াও বিক্রয় প্রতিনিধি ও স্বাস্থ কর্মী নিয়োগের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে বেকার যুবক যুবতীরা তাদের ফাঁদে পা বাড়ায়। একবার যারা তাদের ফাঁদে পড়ে তারা আর বেড়িয়ে আসতে পারে না ঐ সকল অবৈধ কর্ম কান্ড থেকে। 

( আশরাফুল ল্যাবরেটরীজ এর অবৈধ ও প্রতারনামূলক কর্ম কান্ড নিয়ে জানতে চোখ রাখুন অপরাধ বিচিত্রার পাতায়)।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button