আশা জাগানো অর্থনীতির গতি
সরকার এখনই পদক্ষেপ নিলে রমজানে সহনীয় থাকবে দ্রব্যমূল্য “বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গঠনমূলক ভূমিকা রাখছেন : রিজার্ভের পতন থামানো, ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখা, টাকা না ছাপিয়েই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তার উদ্যোগ প্রশংসনীয় : জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কমবে মূল্যস্ফীতি : স্বৈরাচারী হাসিনা ও দোসরদের লাখো কোটি টাকা পাচারের ‘মহাক্ষতি’ পুনরুদ্ধার কঠিন চ্যালেঞ্জ” -বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম
আগুনঝরা আন্দোলনের রাজপথে ছাত্র-তরুণ-যুবকসহ হাজারো জনতার তরতাজা প্রাণদান, হাজার হাজার ছাত্র-তরুণের চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ এবং রক্ত-নদীর বিনিময়ে ৫ আগস্ট নবতর স্বাধীনতার ইতিহাস রচিত হয়ে দেশ ও জাতি পেয়েছে ‘নতুন বাংলাদেশ’। গণঅভ্যুত্থান-বিপ্লবে জনরোষের মুখে স্বৈরাচারী, খুনি হাসিনা এবং তার দোসরদের শোচনীয় পতন ও পলায়ন দেখেছে দুনিয়াবাসী।
আওয়ামী লীগ নামের ফ্যাসিবাদী দানবের নেত্রী হাসিনা ও তার দোসররা, উচ্ছিষ্ট ও সুবিধাভোগীরা পালিয়ে গেলেও এবং অনেকেই এখনো গর্তে লুকিয়ে কিংবা ধরা পড়লেও তারা লাখো কোটি টাকাসহ প্রচুর সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে আগেই। একটানা ১৭ বছরের লুটপাট, মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি-অনিয়ম, অপচয়-অপব্যয়, বিদেশে অর্থ-সম্পদ পাচারের মাধ্যমে দেশের সমগ্র অর্থনীতিকে ফোকলা বানিয়ে পালিয়েছে হাসিনার আওয়ামী গোষ্ঠী ও তার সুবিধাভোগী দোসররা। স্বৈরশাসক হাসিনা ও তার উচ্ছিষ্টভোগী সাঙ্গপাঙ্গদের চাঁদাবাজি, ভাগাভাগি, দখলবাজি, লুটপাট-দুর্নীতির রাম-রাজত্বের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিল রাজধানী ঢাকায় গণভবন, সচিবালয়, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয়সমূহ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত মফস্বলে জেলা-উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড, ইউপি পর্যায় অবধি।
ফ্যাসিবাদী লুটেরা হাসিনা ও তার আস্থাভাজন এস. আলমের মতো দোসররা ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ রীতিমতো ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। বিপর্যস্ত করে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-প্রতিষ্ঠান। প্রায় হারিয়ে গেছে বিনিয়োগের জন্য আস্থার পরিবেশ। আজও ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে কষ্ট পাচ্ছে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। দেশের অর্থনীতির এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ^ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার। জাতীয় অর্থনীতির বিশেষ করে দেশের স্পর্শকাতর ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতসমূহের ধ্বংসস্তূপকে অতিক্রম করে ধীরে ধীরে সঙ্কট উত্তরনের লক্ষ্যে স্বাভাবিক অবস্থার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ বলছেন, সরকারের দৃশ্যমান বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ফলে আশা জাগাচ্ছে দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি। ফিরছে সার্বিক স্থিতিশীলতা। অর্থনীতিতে হচ্ছে আশার সঞ্চার। অর্থনীতি বর্তমানে নেতিবাচক ধারায় নয়; বরং স্থিতিশীলতার দিকেই যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির আকার শিগগিরই হ্রাসের দিকে যাবে। দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থা, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে দৈনিক ইনকিলাব প্রতিনিধির গতকাল আলাপচারিতা হয় একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলামের সঙ্গে।
ড. মইনুল ইসলাম বলেন, স্বৈরাচারী হাসিনার সরকার ও তার দোসররা বিগত সাড়ে ১৪ বছরে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামিয়ে মারাত্মক বিপদে ফেলে পালিয়ে গেছে। হাজারো-লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এই পাচার করা অর্থ-সম্পদ উদ্ধার করা সহজ নয়; বরং পাচারের ‘মহাক্ষতি’ কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যাবে তা কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। শিগগিরই পাচারের টাকা ফেরত আনা সম্ভব হবে তা আশা করা যায় না।
অর্থনীতির হালচাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির চলমান গতি-প্রকৃতি আশা জাগানিয়া। সরকার অর্থনীতিতে আশার সঞ্চারের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ইতোমধ্যে কম সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ভালো ভূমিকা রাখছেন। তার পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক। রিজার্ভের পতন থামিয়ে দেয়া, ডলারের মূল্য স্থিতিশীল অবস্থায় রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা না ছাপিয়েই দুর্বল ও রুগ্ন ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তার উদ্যোগ ও এ ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভালো তারল্য রয়েছে এমন ব্যাংকগুলোর তারল্যকে সমন্বয় করা হচ্ছে।
এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনি সময়োপযোগী ভূমিকা রাখছেন। প্রসঙ্গত গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকসমূহের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালকবৃন্দ) সভায় দেয়া বক্তব্যে কোনও ব্যাংক যাতে ডলার ধরে রেখে মার্কেট ম্যানুপুলেশন না করে। কোনো ব্যাংকের ইমপোর্ট পেমেন্ট করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমদানি এলসি খোলায় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, মূল্যস্ফীতিতে দরিদ্র্য ও সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছে। আসছে ডিসেম্বর মাস থেকে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে হ্রাসের দিকে যাবে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে মূল্যস্ফীতি আরো কমবে। তখন সিঙ্গেল ডিজিটের দিকে যাবে। বর্তমান মৌসুমের একটি বাস্তবতা হচ্ছে কার্তিক মাসের ‘মঙ্গা’, ‘আকাল’ বা ‘রাঠ’ কথাটা এদেশে দীর্ঘকাল ধরেই কমবেশি প্রচলিত। তবে অগ্রহায়ণে আমন ধান কাটা শুরু হলে চালের দাম কমবে। তখন অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যও কমে আসবে। মাহে রমজানে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক ও পর্যাপ্ত রাখতে প্রয়োজনীয় আমদানিসহ সব ক্ষেত্রে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে রমজানে সহনীয় ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে দ্রব্যমূল্য।
প্রসঙ্গত গত সোমবার রাজধানী ঢাকায় এক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মূল্যস্ফীতি কমাতে ৮ মাস সময় চেয়ে বলেছেন, এই সময়ে মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশে নেমে আসবে। এর আগের সপ্তাহে তিনি মূল্যস্ফীতি হ্রাসে ১৮ দেশবাসীকে ধৈর্য্য ধারণের অনুরোধ করেছিলেন। সর্বশেষ হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতি ক্রমশ স্থিতিশীলতার দিকে এগুচ্ছে। অর্থনীতির পরিবেশ স্থিতিশীল হয়ে উঠলে বিদেশী যৌথ ও একক বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। তবে তার আগে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাহলে বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগ মিলে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে। বিনিয়োগ দেশীয় হোক আর বিদেশী হোকÑ তা বাড়াতেই হবে। অন্যথায় কর্মসংস্থানের বর্তমান স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা যাবে না।
তিনি বলেন আগামীতে সহসা জিডিপি প্রবৃদ্ধি খুব বেশি আশা করা যৌক্তিক হবেনা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান ও আশানুরূপ ভূমিকা এ যাবত তেমন ছিল না উল্লেখ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আগের উপদেষ্টা ভালো করেননি। তাই সরকার নতুন উপদেষ্টা (বাণিজ্য) কেমন ভূমিকা রাখেন দেখা যাক। তিনি মনে করেন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের পর দেশে সামাজিক অস্থিরতা আগের মতো নেই।