মোস্তাফিজুর রহমানঃ
একই প্লটে ভবন নির্মাণের জন্য আলাদা করে দুটি নকশার অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)এর বিরুদ্ধে। দুবারই প্লটটি খালি দেখিয়ে আবেদন করা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তখন যথাযথ প্রক্রিয়ায় তথ্য যাচাই করেননি, সেই সুযোগে প্রথম নকশায় দেখানো ফাঁকা জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে আরেকটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় এই নকশায় প্রথম ভবনের জায়গাটি ফাঁকা দেখানো হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত জালিয়াতি ধরা পড়ায় ভবন দুটির নির্মাণকাজ বন্ধ এবং রাজউকের তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, রাজধানীর উত্তরখানের মাজার চৌরাস্তায় ২০ কাঠার একটি প্লটে বেজমেন্টসহ দশতলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০২১ সালে নকশা অনুমোদন করে রাজউক। ওই নকশায় প্লটের অর্ধেক ফাঁকা রাখা হয়। নকশাটি পাস হওয়ার পর প্লটের উত্তর পাশে খালি রেখে দক্ষিণের ১০ কাঠায় বেজমেন্টসহ দোতলার কাজ সম্পন্ন করা হয়। এরপর ওই ভবনের জায়গাটি খালি দেখিয়ে ২০২২ সালে আরেকটি নকশার অনুমোদন নেওয়া হয়। এরপর খালি জায়গাটিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে আরেকটি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। এরই মধ্যে দুটি ভবনেরই দোতলার কাজ শেষ করেছেন জমির মালিকরা।
রাজউকের এক কর্মকর্তা অপরাধ বিচিত্রাকে বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ২০ কাঠার ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণ করতে হলে জমির অর্ধেক খালি রেখে নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক। কিন্তু উত্তরার ওই জমির মালিকরা তা না করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পুরো ২০ কাঠা জমিতে পরপর দুটি ভবন নির্মাণ করছেন। তারা রাজউকের ৩০৭নং ফরমের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে ইমারত নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি জানার পর গত ১২ মে রাজউকের সভায় এই ভবনের নকশা বাতিল ও ভবন নির্মাণকাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
রাজউকের অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী পলাশ সিকদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অপরাধ বিচিত্রাকে বলেন, ‘অ্যাকশনে যাওয়া ছাড়া রাজউকের হাতে আর কোনো অপশন নেই। তবে মালিকরা এ বিষয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। রিট করলে হয়তো আদেশ তাদের পক্ষেও চলে আসতে পারে। আদেশ পেলে পরে আবার কাজ করতে পারবে।’
তার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে জালিয়াতিতে সহযোগিতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন।
ভবন নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান পুলিশ পরিদর্শক আফতাব শেখ জানান, ‘রাজউকের নিষেধাজ্ঞার খবর পেয়ে তাদের মধ্যে অনেকেই এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
ঝামেলা তৈরি হওয়ায় আগের কমিটি বিলুপ্ত করে তাকে নতুন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেন করে কীভাবে এই প্ল্যান পাস করানো হয়েছে, তা তার জানা নেই।
আরেকটি ভবন কমিটির চেয়ারম্যান পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘অজ্ঞতার কারণে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। সব হারিয়ে আমরা আজ সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। আমরা এ ঘটনায় জড়িত রাজউকের কর্মকর্তাদের বিচার চাই।’
ভবন মালিকদের একজন আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা চাই অবৈধভাবে যারা প্ল্যান দিয়েছে রাজউকের সেই কর্মকর্তাদেরও যেন আইনের আওতায় আনা হয়। আমরা রাজউকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে তাদের বিচার দাবি করেছি।’
এদিকে রাজউক কীভাবে একই প্লটে দুটি নকশার অনুমোদন দিল, সে বিষয়ে জানার জন্য সংস্থাটির পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২) মোবারক হোসেন ও আগের অথরাইজড অফিসার মাহাবুব হোসেনকে বারবার ফোন দেওয়া হলেও তারা ফোনকল গ্রহণ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও জবাব দেননি।
জালিয়াতির এই ঘটনা অবহিত করে মন্তব্য চাওয়া হলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান অপরাধ বিচিত্রাকে বলেন, ‘ভবন নির্মাতারা সুযোগ নিতেই চাইবে। ডিজাইন, প্ল্যান, সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে পরিদর্শকসহ রাজউকের যেসব কর্মকর্তা এমন জঘন্য অপরাধে জড়িত থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অতীতে তাদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। বর্তমান চেয়ারম্যান এসব অপরাধ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই শর্ষের ভেতরে থাকা ভূত তাড়ানো যাবে।’
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার অপরাধ বিচিত্রাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ওই প্লটের নকশা বাতিল করা হয়েছে। নির্মাণকাজও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় রাজউকের যেসব কর্মকর্তা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
তার সঙ্গে ভবন মালিকদের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি তাদের দ্রুত ভবন দুটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি। এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।’