অপরাধঢাকা বিভাগদূর্নীতি

তিতাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠিকাদার মো: হিরুর অবৈধ গ্যাস বানিজ্য জমজমাট

সুইটি সিনহা ও হাকিম : বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোতে রান্নাবান্না ও কলকারখানার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দিন দিন গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা- ময়মনসিং শহরে এই গ্যাসের চাহিদা মিটাতে গ্যাস বিপণনের কাজ করে থাকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি:।দেশের চাহিদার মোট ৭০ শতাংশ গ্যাস বিপণনকারী এই প্রতিষ্ঠানটির বৈধ গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লক্ষ ৭৮ হাজার ৭৫৭ টি হলেও অবৈধ গ্রাহক রয়েছে প্রায় তিন লক্ষেরও বেশি। ২০১৪ সালের ৩০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন গ্রাহক বৃদ্ধির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হলে অবৈধ গ্রাহকের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় অবৈধভাবে আবাসিক এর গ্যাস ব্যবহার করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী।ফলে নাগরিক জীবনের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে পড়েছে গ্যাস ভোগান্তির অধ্যায়। বিভিন্ন সময় তিতাসের কর্মকর্তারা ও স্থানীয় ঠিকাদার মিলিতভাবে মোটা টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে আবাসিকের গ্যাস থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ করে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীদের। এদিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ী ও ওয়ারী।একদিকে যেমন কল কারখানার চাহিদা অন্য দিকে নতুন তৈরী হওয়া আবাসিক ভবনগুলোতে গৃহস্থালি কাজে গ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই ভাবে নতুন নতুন তৈরী হওয়া খাবারের হোটেল গুলোও এলপিজি গ্যাসের বিকল্প হিসাবে আবাসিকের গ্যাস ব্যবহার করছে।আবাসিকের গ্যাস অবৈধ ভাবে ব্যবহার করতে তাদের শরণাপন্ন হতে হয় ঠিকাদার ও তিতাসের কর্মকর্তাদের। এই সুযোগে রাতারাতি কোটিপতি বোনে যায় তিতাসের অনেক কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা। অনুসন্ধানে জানা যায় কেবল মাত্র ওয়ারী থানা এলাকায় প্রায় ৩শত খাবারের হোটলের রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় আবাসিকের গ্যাস যা শাস্তি যোগ্য অপরাধ। এছাড়াও আরো একটি অনুসন্ধান থেকে জানা যায় ঢাকা মেট্রো বিপনন বিভাগ -০২ এর অধীনেই রয়েছে প্রায় ১০ হাজার অবৈধ গ্রাহক।কেউ কেউ আবাসিকের গ্যাস বানিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করছে,কোন কোন ভবনে রয়েছে চুলাবৃদ্ধি,কোথাও আবার সম্পূর্ণ লাইনটি চুরি করে টেনে নেওয়া।বিভিন্ন সময়ে অভিযান নামক নাটকীয়তা করে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও হয়না তেমন কোন জরিমানা,ফলে সরকারী কোষাগারে রাজস্ব ফিরে পাওয়ার বিষয়টা অনেকটা ভাঁড়ে ও ভবানী।

অধিকাংশ লাইন পরবর্তী দিনেই আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।তিতাসের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সাথে যোগাযোগ করে পুনরায় রাইজার স্থাপন করে বলেই জানিয়েছেন অধিকাংশ বাড়িওয়ালারা।তাদের দাবী গ্যাস বিতরন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কখনো প্রয়োজনের তাগিদে আবাসিকের গ্যাস থেকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার স্বার্থে বানিজ্যিক ভাবে গ্যাস ব্যবহারের দরকার পড়লে স্থানীয় ঠিকাদারদের জানালে তারাই সংযোগ দিয়ে যান এবং দেখাশোনাসহ তিতাসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে।এভাবে অবৈধ সংযোগ দিতে গিয়ে তাদের গুনতে হয় বৈধ বিলের সমান/ তারও বেশি টাকা।ঠিকাদার ও তিতাস কর্মকর্তাদের টাকা দিয়েও মাঝে মাঝে দাঁড়াতে হয় শাস্তির দাঁড় গড়ায়।কেটে নেওয়া হয় রাইজার,গুনতে হয় জরিমানা।ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান অসাধু ঠিকাদার ও তিতাস কর্মকর্তারা।ঘটনার প্রেক্ষীতে এসকল বিষয়ে অনুসন্ধান করতে সাংবাদিকদের একটি দক্ষ, চৌকস টিম গত ১৪ই অক্টোবর ঢাকা মেট্রো বিপনন বিভাগ ০২ এর অধীনস্থ ওয়ারী লাল মোহন সাহা স্ট্রিটে সরেজমিনে গেলে দেখতে পান ২০০/১ হোল্ডিং এর ৫তলা বিশিষ্ট বাড়ীটির প্রতিটি তলাতেই আবাসিকের গ্যাস থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে হোটেলের রান্নার যাবতীয় কার্যক্রম।শুধু মাত্র এই বাড়ীটিতেই রয়েছে মোট ৭টি হোটেলের রান্নাঘর,রান্নার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে আবাসিকের গ্যাস।সংযোগ স্থাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে হোস পাইপ যা ভবনটি ও সেখানে বসবাসরত সকলের জন্যই বিপদজনক। যে কোন সময় হতে পারে ভয়াবহ অগ্নিবিস্ফোরণ। অন্য দিকে ৭টি হোটেলের আনুমানিক ফাঁকি দেওয়া রাজস্বের পরিমানও নেহাত কম নয়।বানিজ্যক লাইন হলে প্রতিমাসে যেখানে গুনতে হতো ১.৫-২ লক্ষ টাকা।সেখানে শুধু মাত্র ৪টি চুলার আবাসিক বিল ৪৩২০টাকা দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছে সরকারী হিসাব।এ বিষয়ে বাড়ীর মালিক মো:হাসানের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি দূরে আছেন জানিয়ে প্রতিনিধি হিসাবে সরেজমিনে সংবাদকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎে পাঠান তিতাসের ঠিকাদার মো:হিরুকে।উত্তরা কনস্ট্রাকশন লি: এর নামে ১.৩ পর্যন্ত সংযোগ স্থাপনে সক্ষম তিতাসের একজন লাইসেন্স প্রাপ্ত ঠিকাদার পরিচয় দিয়ে মো:হিরু শুরু করেন আলাপচারিতা। কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে গোপন ক্যামেরায় ধারনকৃত হিরুর ভিডিও বক্তব্যে বেরিয়ে আসে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির তথ্য।তিনি জানান বাড়ীর মালিক হাসান সাহেব ঢাকা মেট্রো বিপনন বিভাগ -০২ এর কতিপয় কর্মকর্তাদের মাসোয়ারা দিয়েই এই অবৈধ সংযোগটি পরিচালনা করছেন।আপনার নিউজ করার থাকলে করেন।এখান থেকে তিতাসের অফিসাররা টাকা নেয়।লেয়াজু করেই হাসান গ্যাস ব্যবহার করছেন।তিতাসের কে এসে টাকা নেন এমন প্রশ্ন করলে ঠিকাদার হিরু জানান পরিদর্শনে আসা প্রায় প্রতিটি টিমের সদস্যদেরকেই বাড়ীর মালিক হাসান সাহেব টাকা দিয়ে থাকেন।একজন ঠিকাদার হয়েও অবৈধ এই গ্যাস সংযোগের বিষয়ে কথা বলতে তিনি কেন এসেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মো: হিরু প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে কৌশলে মালিক হাসান তার আত্মীয় হয় বলে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।তিনি কখনও এসকল অবৈধ সংযোগ নিয়ে ডিজিএম মহোদয়কে অবগত করেছেন কিনা/ এই লাইনটি কখনো কাটা হয়েছিলো কিনা জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেন ম্যানেজমেন্টই খারাপ।তারা আসেন, লাইন দেখেন,টাকা নিয়ে চলে যায়।তিতাসের সকল কর্মকর্তারা এই টাকার অংশ পেয়ে থাকেন।একজন তিতাসের ঠিকাদারের মুখ থেকে এমন সব কথা শুনলে সহজেই অনুমান করা যায় কতটা বেহাল কার্যক্রম তিতাসের কর্মকর্তাদের ও ঠিকাদারদের।নিজেদের আরাম আয়েশ মিটাতে প্রতি নিয়ত অবৈধ পন্থায় গড়ে তুলছেন কালো টাকার পাহাড়।আর স্থানীয় ভাবে ঠিকাদার হিরুই টাকা আদায় কারী।তিতাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অত্র এলাকায় অবৈধ সংযোগ দিয়ে চাঁদা বানিজ্য করাই যে হিরুর দৈনন্দিন কাজ সেটা দিবালোকের মত সত্য । এবিষয়ে ঐ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান অত্র এলাকায় গড়ে ওঠা ৮০ ভাগ হোটেলই রান্নার কাজে আবাসিকের গ্যাস ব্যবহার করে যে সংযোগ গুলো ঠিকাদার হিরুর নেতৃত্বে দেওয়া।তিতাসের কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করা সহ বাড়ীর মালিকদের খুশি করতে হয় হিরুকেও।কখনও কখনও টেবিলে বসেই তিতাসের কর্মকর্তারা গুনে গুনে বুঝে নেন মাসোয়ারার টাকা।বিষয়টি নিয়ে আরো বিস্তর জানার আগ্রহ থেকে সংবাদকর্মী সুইটি সিনহা মো: হিরুর সাথে মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করলে বেরিয়ে আসে আরো ভয়াবহ তথ্য। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার মত অবস্থা। শুরুতে স্বাভাবিক ভাবেই ঠিকাদার হিরু জানান তার সমগ্র ঢাকাতে কাজ করার সক্ষমতা রয়েছে। দীর্ঘ ৩০বছর ধরে তিনি ঠিকাদারী পেশায় নিয়োজিত।রয়েছে দুই সন্তান ও স্ত্রী। দুই সন্তানকেই করেছেন উচ্চ শিক্ষিত।মেয়েকে বিয়ে দিলেও ছেলে এখনও অধ্যায়নরত।রয়েছে ঢাকাতে নিজের বহুতল বাড়ী।এছাড়াও রয়েছে প্রচুর ধন সম্পদ।পরবর্তীতে যদি সেগুলো বাবার সম্পত্তি বলে চালিয়েদেন।তিনি জানান আজও রায়েরবাগে এরকমই (অবৈধ)একটা সংযোগ অফিসের সাথে যোগাযোগ করে দিয়ে এসেছেন।আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ঠিকাদার হিরু রাগান্বিত হয়ে হারিয়ে ফেলেন মস্তিষ্কের সংযম তখনই বের হয়ে আসে অনিয়ম ও দূর্নীতির কথিত আয়নাঘর।তিনি জানান আমার কিছুই করা সম্ভব নয়।তিতাসের কর্মকর্তারাই যেখানে ঘুষ খায় সেখানে আমার কি করতে পারবেন।তারা সকলেই জানেন।লাইন কেটে টাকা খেয়ে পুনরায় সেসকল লাইন আবার জুড়ে দিয়ে যান।আর যদি কোন কারনে আমার লাইসেন্স বাতিল হয় লাগলে আমি অবৈধভাবে আবারও টাকা আয় করে নতুন করে লাইসেন্স বানিয়ে নিবো।একই সাথে তিনি আরো উল্লেখ করে জানান বাড়ীর মালিক হাসানের কাছ থেকে তিতাসের অফিসাররা গুনে গুনে চাঁদা নিয়ে লাইন না কেটে চলে গেছে।কয়েকবার তিনি নিজেও মেট্রো বিপনন বিভাগ -০২ এ গিয়ে মাসোয়ারার টাকা এগিয়ে দিয়ে এসেছেন বলে দাবি জানান।হাসান সাহেবের অফিসের টেবিলের দিক নির্দেশনা উল্লেখ করে বলেন টেবিলের বাম দিকে বসে বসেই তিতাসের অফিসাররা তার যোগসাজশে টাকা নিয়েছেন। এক পর্যায়ে সংবাদকর্মীকে হেনস্তা করতে তিনি বলেন এরকম অনেক সাংবাদিক তার চেনা রয়েছে। অনেক বড় মাপের সাংবাদিক ও তিতাসের উর্ধ্বতন কর্মকতাদের সাথে তার গভীর সখ্যতা রয়েছে। দীর্ঘ ৩০ বছরে অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ ও তিতাসের কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হওয়ায় ঠিকাদার হিরুর নাগাল পাওয়া যেন বেজায় দুঃসাধ্য। এ বিষয়ে বাড়ীর মালিকের সাথে কথা বললে তিতাসের কর্মকর্তা ও মো: হিরুর মাসোয়ারা নেওয়ার সত্যতা পাওয়া গিয়েছে।তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন লি:এর ঢাকা মেট্রো বিপনন বিভাগ -০২ এর রেভিনিউ ডিজিএম মো:সাহেদুল ইসলামের সাথে নিউজের স্বার্থে সাক্ষাৎ করলে তিনি জানান লাইনটি কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি ও উপযুক্ত প্রমান পেলে ঠিকাদার হিরুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিতাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হিরুর আনিত অভিযোগ ও অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি মার্কেটিং ডিজিএম বিকাশ চন্দ্র সাহার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।পরবর্তীতে মুঠোফোনের মাধ্যমে ডিজিএম বিকাশ চন্দ্র সাহার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ঠিকাদার হিরুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন বলে আশ্বস্ত করলেও তিতাসের কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দূর্নীতি নিয়ে তেমন কোন সৎ উত্তর দিতে পারেন নি।প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে তিনি নতুন এখানে দ্বায়িত্ব পেয়েছেন জানান।.

তিতাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠিকাদার মো: হিরুর অবৈধ গ্যাস বানিজ্য জমজমাট

পর্ব ০১

ঠিকাদার হিরু ও তিতাসের আরো বিস্তারিত আসছে পরবর্তী পর্বে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button