বিবিধশিক্ষা

বাংলাকে ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে রূপান্তর করার শত্রু আমরাই: ভাষার সামাজিক ব্যবহার জরুরী

বাংলাকে ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে রূপান্তর করতে না পারলে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা বার বার ব্যক্ত করেছিলেন একুশের অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি গত বছর প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর এই আশংকাজনক উচ্চারণ আমরা ভুলিনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সে দেশেও বাংলা ব্যাবহারিক ভাষা হিসাবে রুপান্তর এখনো হয়নি। আজ ২০২৩ সাল। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’র আন্দোলনের ৭১ বছর এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার বয়স ৫২ বছর। কোনো সমীকরণই মেলানো যাচ্ছে না, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের, না রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

এই অবস্থায় বিলাতে অভিবাসী বাঙালি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ৭০ দশকে  আবাসন সমস্যার সমাধান, শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা প্রচলন এবং সামাজিক নানা বেনিফিট লাভালোভের আন্দোলন করে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সময় কাটান। সাময়িকভাবে সফল হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুল’ ‘ওসমানী প্রাইমারি স্কুল’ ‘শাপলা প্রাইমারি স্কুল’ এবং কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা ও নামকরণের মধ্যদিয়ে।  চালু হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বাংলা শিক্ষা। আমাদের সন্তানরাও আগ্রহী ছিল কিন্তু সেই আগ্রহ আর নেই, ধরে রাখা যায়নি। আমাদের সন্তানরা আজ শেখে তৃতীয়ভাষা হিসাবে ফ্রেন্স, জার্মান বা মেন্ডারিন । কারণ কি? কারণ, ব্রিটেনের সাথে রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিকভাবে সর্ম্পকিত এসব দেশ ও জাতিসম্প্রদায়। এখানেও লাভালাভের বিষয়টি মুখ্য।

কিন্তু আমাদের আবদার বা স্বপ্ন থামেনি। প্রতিবছর একুশে এলেই শিঁর খাড়া হয়। দাবী-দাওয়া করে বসি বাংলা রক্ষার নানা পথ ও মত নিয়ে। অথচ, আমরা কে না জানি, তৃতীয় প্রজন্মতে কোনো জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ভিনদেশে  আর ঠিকে থাকে না, হারিয়ে যায়। তবুও মন বুঝে না।

অবুঝ মন নিয়েই ভাবতে হবে বিশ্বে বহু ভাষা হারিয়ে গেছে তার ব্যবহারিক প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাবে। যেমন,  আমাদের উপমহাদেশের ‘সংস্কৃত’ ‘পালি’ এবং ইউরোপে ‘হিব্রু ‘ ভাষা হারিয়ে গেছে। অথচ, সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী একশ কোটির ওপরে সংস্কৃতভাষায় ‘মহাভারত’ ও ‘রামায়ন’ তাদের ধর্মগ্রন্থ, একইভাবে ‘বুদ্ধধর্মের অনুসারী একইভাবে একশ কোটির ওপরে ধর্মগ্রন্থ ‘পালি’ভাষায় ‘ত্রিপিটিক’। পাশাপাশি খৃস্ট্রধর্মের বাইবেলের ভাষা ‘হিব্রু’র  দশা ‘নাই’ এর খাতায়। কারণ, একটি-ই। ভাষার ব্যবহারিক মর্যাদাদান হয়নি।

প্রথমেই বলছিলাম, বাংলার ব্যবহারিক রুপান্তরের কথা। কেন আমরা ব্যর্থ বা সে পথে হাঁটছি  না। যদি তলিয়ে দেখি, বা গভীরে প্রবেশ করি, তাহলে দায়ী আমাদের রাজনীতি। আমরা এমন দাম্ভিক রাজনীতির ভেতরে মনন ও শরীর সেঁধিয়ে দিয়েছি, লোপাট-করার হীন মানসিকতার তলে চাপা পড়ে গেছে আমাদের ভাষার ব্যবহারিক কাঁন্না। অফিস আদালত, বিজ্ঞানে তো বাংলা ব্যবহার শুরু করার দায় সরকার ও আমাদের। কিন্তু সরকার ও আমাদের নাকের ডগায় দেশে লক্ষাধিক কিন্ডার গার্টেন স্কুল সদর্পে ভিনদেশী ভাষা আমাদের কোমলমতি শিশুদের মুখে চুষনির মত ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর বড় হওয়ার পরও এক শ’য়ের ওপরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ গেলাচ্ছি। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা মাধ্যম তো নয়ই, বরং বাংলা বিভাগও নেই। অতএব, বাংলা ভাষার শত্রু তো আমরা  নিজেরাই। এই বেহাল অবস্থায়, খুঁজতে হবে দেশে হউক বা বিদেশে হউক বাংলাভাষার অন্তত সামাজিক ব্যবহারের কথাটি। অফিস আদালত, বিজ্ঞানে তো বাংলা ব্যবহার শুরু করার দায় সরকারের।

ব্রিটেনের কথাই যদি বলি, তবে আমরা আমাদের সন্তানদের সাথে বাংলা কথা বলার চর্চা চালু রাখলে বাংলা ভাষাকে  কয়েকযুগ জীবিত রাখা যাবে। অভিবাসী ভাষা কখনোই দীর্ঘদিন ঠিকে থাকে না, পারিপার্শ্বিক ও সেখানকার মূলধারার ভাষার চাপে। এরপরও, কিছুটা তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে, যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সচেতনভবে ক্রিয়াশীল রাখা যায় এবং সামাজিক বন্ধন থাকে শিকড় সন্ধানী—তাহলে  কিছুদিন বিলাতে বাংলা  ভাষার গন্ধ বাতাসে উড়বে। আর যদি অভিবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তবে বাংলা ভাষার মধুময় স্পর্শ দীর্ঘদিন লেগে থাকবে ঠোঁটে । বাংলাটাউন এবং হোয়াইটচ্যাপালে বাংলা শোনা যাবে আরো কিছুদিন।

লেখক: হামিদ মোহাম্মদ, কবি ও সাংবাদিক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button