সংবিধান শুধু আইনজ্ঞদের বিষয় নয়, এটি জনগণের বিষয়
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠন, আইনসভার মেয়াদ চার বছর করা, দুই বারের বেশি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, জাতীয় পরিষদের নির্দলীয় সদস্যদের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি এবং বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনসহ একাধিক বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন আইন ও বিচারাঙ্গনের বিশ্লেষকরা। এ ছাড়াও গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতে কার্যকর সংবিধান প্রত্যাশা করেন তারা। একইসঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা ও শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণেরও মত দেন তারা। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এক সেমিনারে এসব পরামর্শ দেন বক্তরা। আইন, আদালত ও মানবাধিকার বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সালেহ উদ্দিন। এতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিপ্লব-উত্তর বাংলাদেশে যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছি সেটা তাদের (শহীদদের) প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা জানানো। কিন্তু আমাদের কিছু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বিষয় চিন্তায় রাখতে হবে। একই অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম. এ মতিন বলেন, যে সংবিধান ফ্যাসিস্টদের জন্ম দিয়েছে, বিপ্লবের পর সেই সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীকে ক্ষমতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪০০ আসন হলে ১০০টি নারীর জন্য বরাদ্দ করতে হবে। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন, মাসদার হোসেন মামলার বাদী অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম, ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়, সারা হোসেন, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, আইনজীবী আহসানুল করিম, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদ।
সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবনায় সালেহ উদ্দিন জাতীয় পরিষদ নিয়ে বলেন, জাতীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা হবে ২০০। তারা জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে অভিহিত হবেন। তাদের মধ্যে ৬৪ জন নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ১২ জন নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের মেয়র, ২৫ জন সংরক্ষিত মহিলা এবং ১০ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ২৫ জন সংরক্ষিত নারী সংসদ-সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হবেন। অবশিষ্ট ৮৯ জন জাতীয় সদস্য নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হবেন। এরূপ বণ্টনের ফলে যে রাজনৈতিক দল আনুপাতিক হারে যত আসন পাবে, এর ভিত্তিতে তারা মনোনয়ন দেবে। তবে শর্ত থাকে, রাজনৈতিক দলগুলো যত আসন পাবে, এর অর্ধেক সদস্য নিজ দলীয় সদস্যদের মধ্যে থেকে, বাকি অর্ধেক সদস্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করবে। তবে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না। সংরক্ষিত অপর ১০ জনকে প্রেসিডেন্ট সরাসরি মনোনয়ন দেবেন। এ মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট যতদূর সম্ভব সমতাবিধান করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করবেন। খসড়ায় বলা হয়, জাতীয় পরিষদ হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও আইনপ্রণয়ন সভা, যা অর্থনৈতিক নীতি, জাতীয় নিরাপত্তা নীতি, বৈদেশিক সম্পর্কের নীতি এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিকাশে পথরেখা প্রণয়ন করবে। জাতীয় বাজেট (অর্থবিল) ছাড়া জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইন চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে জাতীয় পরিষদ। জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপনের ছয় মাস আগে জাতীয় পরিষদে প্রাক-বাজেট আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় পরিষদের মেয়াদ হবে চার বছর। জাতীয় সংসদ নিয়ে বলা হয়, জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা থাকবে ৩০০। কোনো সংরক্ষিত মহিলা আসন থাকবে না। তবে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল দশ ভাগ নারী সদস্যকে মনোনয়ন দিতে হবে। সরকার গঠন, সরকারের প্রতি অনাস্থা এবং অর্থবিল পাসের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকবে। এর বাইরে রাষ্ট্রের সকল আইন প্রণয়ন জাতীয় সংসদের প্রাথমিক অনুমোদনের পর জাতীয় পরিষদ চূড়ান্ত অনুমোদন দিবে। জাতীয় পরিষদ এবং সংসদ নিজেদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিজেরাই বৃদ্ধি করতে পারবেন না। কোনো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন না। তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির আবেদন সাংবিধানিক আদালত বিবেচনা করবে। নাগরিকের অধিকার বিষয়ে বলা হয়, আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দণ্ড হতে পারে-এমন অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে আদালতের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। তবে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করবে-এমন সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আটক রাখা যাবে না। তবে সন্দেহের উপযুক্ত ভিত্তি থাকতে হবে। আদালতে হাজিরের সময় প্রতিবেদনে উপযুক্ত কারণগুলো উল্লেখ করতে হবে। অহেতুক হয়রানি করা যাবে না। আদালতের অনুমতি ছাড়া নাগরিকের গৃহে প্রবেশ ও তল্লাশিতে পুলিশের অধিকার থাকবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রস্তাবনায় তিনি বলেন, জাতীয় পরিষদের যেসব রাজনৈতিক দলের অরাজনৈতিক সদস্য আছেন তাদের এক জন করে প্রতিনিধি নিয়ে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধাবধায়ক সরকার গঠন’ বিষয়ক একটি সার্চ কমিটি গঠিত হইবে। ওই কমিটিতে সংসদের সরকারি দলের নেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা অথবা তাহাদের একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। জাতীয় পরিষদের অধ্যক্ষ এই সার্চ কমিটির সভাপতি হইবেন। তাহারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের একজন নির্দলীয় সদস্যকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এবং পনেরো জন উপদেষ্টার মধ্যে দশ জন নির্দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে সুপারিশ করিবেন। সুপারিশ পাওয়ার পর তিনি প্রধান উপদেষ্টা এবং দশ জন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিবেন। তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা ও দশ উপদেষ্টার তালিকা চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হইলে কমিটির সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে। প্রধান উপদেষ্টা এবং দশ জন উপদেষ্টা নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা অন্যান্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অবশিষ্ট পাঁচ জন উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে লিখিতভাবে সুপারিশ করিবেন। তাহারা জাতীয় পরিষদ অথবা জাতীয় সংসদের নির্দলীয় সদস্যদের মধ্য থেকেও হইতে পারিবেন অথবা আইনসভার বাহিরে সমাজের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের মধ্য থেকেও হইতে পারবেন। তবে তাদের কেউই কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হইতে পারিবেন না। জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন না। সাংবিধানিক আদালত নিয়ে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক আদালত থাকবে। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত একজন প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের তিন জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এবং হাইকোর্টর দুই জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি লইয়া এই আদালত গঠিত হইবে। সাংবিধানিক আদালতে কেউ মামলা দায়ের করতে পারবে না। আদালত শুধু নিজ উদ্যোগে সংবিধান লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা নিজ উদ্যোগে পর্যবেক্ষণ করিতে এবং এহেন কার্য হইতে বিরত রাখিতে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করিতে কিংবা এই ধরনের কোনো কার্যসম্পাদন হইলে তাহা অবৈধ ঘোষণা করিতে পারিবে। সংবিধানের কোনো ব্যাখ্যার প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ অধ্যক্ষ ও স্পিকার সাংবিধানিক আদালতের মতামত গ্রহণ করিতে পারিবেন। এমনকি নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের কোনো চাহিদা পূরণে অনীহা দেখালে কমিশন সাংবিধানিক আদালতে অভিযোগ করতে পারবে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন নিয়ে বলা হয়, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ দিবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশনে সদস্য হবেন আইনমন্ত্রী, আপিল বিভাগের একজন এবং হাইকোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক। অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সরকারি ও বিরোধী দল ও জাতীয় পরিষদের অধ্যক্ষ মনোনীত একজন করে সদস্য থাকবেন। ভোটের অধিকার নিয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তা এবং প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ভোটের অধিকার নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করলে কিংবা ভোট প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটের ৫০ ভাগ প্রদত্ত না হলে নির্বাচন বাতিল হবে এবং পুনরায় দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক দেশে ১৮ বছর পর্যন্ত বসবাস করলে জাতীয় সংসদ ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অযোগ্য হবেন না। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে বলা হয়, রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ও গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমিটি গঠন হয় কিনা তা নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করবে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন বা ছদ্মনামে কোনো সংগঠন থাকবে না। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল নিয়ে বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ রেখে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কাউন্সিলের প্রধান হবেন রাষ্ট্রপতি। সরকার প্রধান, আইন সভার অধ্যক্ষ, স্পিকার, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, তিন বাহিনী প্রধান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব কাউন্সিলের সদস্য হবেন। ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে বলা হয়, সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থা ভোট এবং অর্থ বিল ছাড়া আর সকল কিছুতে স্বাধীনভাবে মত প্রদান ও ভোট দেয়ার অধিকার আইন সভার সদস্যদের থাকবে। এ ছাড়াও সরকারি দপ্তরে নেতা-নেত্রী বা সরকারপ্রধানের বদলে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় প্রতীক থাকবে। রাষ্ট্রের শত্রু ছাড়া কোনো নিবর্তনমূলক আইন থাকবে না। প্রেসিডেন্টের দণ্ড মওকুফের কোনো স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা থাকবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে নির্দলীয় ভিত্তিতে। এক ব্যক্তি সংসদের একাধিক আসনে নির্বাচন করতে পারবে না। ন্যায়পাল থাকবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিপ্লবত্তোর বাংলাদেশে যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছি সেটা তাদের (শহীদদের) প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা জানানো। কিন্তু আমাদের কিছু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বিষয় চিন্তায় রাখতে হবে। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে যদি তাকাই তাহলে এই প্রস্তাবনাগুলো (খসরা) এই সরকারের জায়গা থেকে সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ আছে কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার। কেন না এই অনুচ্ছেদে আপনি সবকিছু করতে পারবেন শুধু সংবিধান সংশোধন ছাড়া। তিনি বলেন, এখন সংসদ নেই, গণভোট নেই- এসব প্রশ্নগুলো এখানে যৌক্তিক ও আইনগতভাবে আসবে। গণতন্ত্র যদি ঠিক থাকে, যদি ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সব ঠিক থাকবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম. এ মতিন বলেন, যে সংবিধান ফ্যাসিস্টদের জন্ম দিয়েছে, বিপ্লবের পর সেই সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে। কেন না বিপ্লব তো সংবিধানের আওতায় হয়নি। এই বিপ্লব ব্যর্থ হলে তো বিপ্লবীদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হতো। এখন যারা জীবন দিলো, তাদের যে চিন্তা-ভাবনা, তাদের যে চাওয়া-পাওয়া এগুলোকে ধারণ করে সংলাপের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা করা এবং একটি নির্বাচন করাই হোক লক্ষ্য। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা এসে সংবিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। তাহলে আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারবো। সংবিধানের আকার ছোট করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সংবিধান পুনর্লিখন নাকি সংশোধন হবে, সেটা জনগণের সিদ্ধান্ত। তবে সেটা তো সংবিধানে লেখা থাকবে না। সবসময় মানুষের অলিখিত অধিকার অসংখ্য থাকবে, কিন্তু কিছু কিছু অধিকার থাকবে লিখিত। তবে লিখিত থাকার অর্থ এই নয় যে এর বাইরে আমাদের কোনো অধিকার থাকবে না।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধান শুধু আইনজ্ঞদের বিষয় নয়, এটি জনগণের বিষয়। এখানে নাগরিকদেরও মতামত থাকতে হবে। তিনি বলেন, সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ওই সংশোধনী ছিল একটা ধৃষ্টতা। এর মাধ্যমে সংবিধানকে কলুষিত করা হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ পরিবর্তন করে ফেলা হয়। এক সংসদকে আরেক সংসদের বেঁধে ফেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে উচ্চ আদালতে চলমান মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ সংশোধনী বাতিল হলেই তত্ত্বাবধায়ক ফিরে আসবে না। এজন্য পরবর্তী সংসদ বিষয়টি তুলতে হবে। বদিউল আলম মজুমদার জাতীয় সংসদে ৪৫০ আসন এবং এর মধ্যে নারীদের জন্য ১০০ আসন বরাদ্দ রাখার দাবি জানান। একই সঙ্গে শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেন দেন। সংবিধানের পুনর্লিখন আদৌ সম্ভব নয় এবং সে প্রক্রিয়াও সংবিধানে নেই উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি অতিক্রম করেছে। এখন একটা নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এখন সংবিধানের কিছু জায়গায় নতুন চিন্তা-ভাবনা হতেই পারে। তাই মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত কি কি ধরনের প্রতিকার আমরা পেতে পারি, ভবিষ্যতে কি করতে পারি সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তিনি বলেন, একটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, গণতন্ত্রে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তারাই তো সরকার গঠন করে। কিন্তু ওই অবস্থায় যারা সংখ্যালঘু, শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, ভিন্ন মত ও ভিন্ন গোষ্ঠীর যারা তাদের অধিকার তো রক্ষা করতে হয়। সেটার জন্যই কিন্তু সংবিধান এবং সেজন্য আমাদের সংবিধানে যারা সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক, সেটা ভাষার কারণে, লিঙ্গের কারণে, প্রতিবন্ধিতা ও জাতিসত্ত্বার কারণে হতে পারে, তাদের অধিকার শুধুমাত্র সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারবো। জেষ্ঠ আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ৫৩ বছরে আমরা একটা ভালো নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। গত ১৫ বছরে আইন করে লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদকে একটা চুরির আইন বানানোর সংস্থায় পরিণত করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার চর্চার মতো পরিস্থিতি তৈরি না করলে কোনো চেষ্টাই ফলপ্রসূ হবে না। অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা নাগরিকদের প্রজা মনে করেন। আমরা আসলেই প্রজা হয়ে গেছি। সংবিধান বার বার ব্যর্থ হয়েছে। নাগরিকের ক্ষমতা নেই। তাই জনগণের ক্ষমতার চর্চার সুযোগটা আসেনি। সংসদ সদস্যরা যতক্ষণ পর্যন্ত জবাবদিহিতার আওতায় না আসবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের প্রজা হয়েই থাকতে হবে।