রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বের প্রকৃতি
মহান আল্লাহ মহানবী (সা.)-এর মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি যেমন একদিকে ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক, তেমন অন্যদিকে ছিলেন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই একসময় বিকশিত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিণত হয়। এ ছাড়া নবুয়ত লাভের আগে তার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে মক্কায় পবিত্র কাবার রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মক্কার অন্যতম নেতৃস্থানীয় পরিবার মনে করা হতো তার পরিবারকে। এখন প্রশ্ন হলো, নবীজি (সা.) কি বাদশাহ ছিলেন? তাকে সমকালীন অন্য পাঁচজন শাসকের মতোই একজন শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে? নাকি তার পবিত্র নেতৃত্ব ছিল ভিন্ন প্রকৃতির?
রাসুলুল্লাহ (সা.) বাদশাহ ছিলেন না
প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, কোনো সন্দেহ নেই সমকালীন আরব ও মুসলিম সমাজে নবীজি (সা.)-এর প্রশ্নাতীত নেতৃত্ব ছিল এবং তার হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও ছিল, শাসকসুলভ বহু কাজ তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন, তবু প্রচলিত অর্থে তিনি বাদশাহ ছিলেন না। তার ব্যাপারে বাদশাহ শব্দের প্রয়োগ অনুচিত। কেননা প্রচলিত অর্থে বাদশাহ যে সব কিছুর ওপর নিজের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী এবং যে নিজেকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে করে।
অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি আল্লাহর কাছে নিজেকে দায়বদ্ধ বলেই বিশ্বাস করতেন। এ ছাড়া জুলুম, অবিচার ও স্বেচ্ছাচারিতা বাদশাহদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে কল্পনাও করা যায় না। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল এবং দ্বিন বাস্তবায়নে তার খলিফা (প্রতিনিধি)।
খলিফা ও বাদশাহর পার্থক্য
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) ‘ইজালাতুল খিফা’ গ্রন্থে একজন খলিফা ও বাদশাহর পার্থক্য তুলে ধরেছেন।
সেখানে তিনি নিম্নোক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাহলো একবার ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তালহা, জুবায়ের, কাআব ও সালমান ফারেসি (রা.)-এর উপস্থিতিতে জানতে চাইলেন, খলিফা ও বাদশাহর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? সালমান ফারেসি (রা.) বললেন, খলিফা, যিনি অধীনদের মধ্যে ইনসাফ করেন, গনিমতের (রাষ্ট্রীয়) সম্পদ সমানভাবে বণ্টন করেন। তিনি অধীনদের সঙ্গে এমন নম্র আচরণ করেন যেভাবে পরিবারের সঙ্গে করে থাকেন। তখন কাআব (রা.) বললেন, আমার ধারণা ছিল এই অর্থ আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।
একবার মুয়াবিয়া (রা.) মিম্বারের ওপর বসে বলেন, খিলাফত সম্পদ একত্র ও তা খরচ করার নাম নয়, বরং খিলাফত হলো সত্যের ওপর চলা, ইনসাফের সঙ্গে ফায়সালা করা এবং মানুষের মধ্যে আল্লাহর বিধান কার্যকর করার নাম।
(মাওলানা ইদরিস কান্ধলভি (রহ.), মাআরেফুল কোরআন : ৭/৩৮)
রাসুল (সা.) বাদশাহি চাননি
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে আয়েশা! যদি আমি চাইতাম তবে স্বর্ণের পাহাড় আমার সঙ্গী হতো। আমার কাছে একজন ফেরেশতা আগমন করেন, যার কোমর ছিল কাবার সমান, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং বলেছেন, চাইলে আপনি একজন নবী ও বান্দা হতে পারেন এবং চাইলে নবী ও বাদশাহ হতে পারেন। আমি তখন জিবরাইলের দিকে তাকালাম, তিনি আমাকে ইঙ্গিত দিলেন নিজেকে বিনয়ী রাখো (ফলে তিনি বাদশাহর পরিবর্তে বান্দা হওয়াকে বেছে নেন)। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ৫৮৩৫)
বাদশাহি নবীর জন্য সম্মানজনক নয়
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লেখেন, নবীরা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত : ক. যারা আল্লাহর বান্দা ও রাসুল ছিলেন, খ. যারা নবী ও বাদশাহ ছিলেন। আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ‘বান্দা ও রাসুল’ অথবা ‘নবী ও বাদশাহ’ হওয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি ‘বান্দা ও রাসুল’ হওয়াকে বেছে নেন। নবী ও বাদশাহর দৃষ্টান্ত ছিলেন ইউসুফ, দাউদ ও সুলাইমান (আ.)। বান্দা ও রাসুলের দৃষ্টান্ত হলেন ইবরাহিম, মুসা, ঈসা ও মুহাম্মদ (আ.)। বাদশাহ নবীর তুলনায় বান্দা রাসুলের মর্যাদা বেশি। (আল ফোরকান বাইনা আউলিয়াইর রহমান ওয়া বাইনা আউলিয়াইশ শয়তান, পৃষ্ঠা-৩৫)
আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।