এক জন শিক্ষকের মুক্তচিন্তা -১১, ফুটে উঠেছে ১৯৯৯ এর বৈষম্য।
নিউজ ডেস্ক: হুবুহু তার প্রফাইল থেকে তুলে ধরা হলো।
মুক্তচিন্তা -১১
১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাস। দশম শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে প্রথম হয়ে ‘A’ কলে উত্তীর্ণ হয়েছি। তখন ফরম পূরণের জন্য সম্ভবত ১৬০০ টাকা বা তার চেয়ে ১০০ টাকা কম/বেশি ধার্য করা হয়েছিল। ঐ সময়ে আমাদের পরিবারে টানাপোড়েন ছিলো। ১৯৯৫ সালে পাশের ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে আমাদের বাড়ির ৫ খান ঘর পুড়ে যাওয়া, বোনের বিয়ে, ঠাকুরদাদার মৃত্যু (১৯৯৭), নদীরপাড়ের রাস্তা ভেঙে যাওয়ার ফলে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়া ইত্যাদি কারণ ছিলো আর্থিক অনটনের জন্য দায়ী। বাবাকে নিয়ে পরীক্ষা কমিটির কাছে গিয়েছিলাম কিছু অর্থ কমানোর কোনো সুযোগ আছে কিনা সেটা জানার জন্য কিন্তু তাদের ব্যবহারে বাবা খুশি হলেন না।
হতাশা নিয়ে ফিরে এসে ধার করে সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে ফরম ফিলাপ করলাম। কিছুদিন পর একটা সত্যি ঘটনা জেনে মনটা আরও বেশি খারাপ হলো। এক প্রভাবশালীর সন্তান যে কিনা ফেল করে ‘B’ কলে উত্তীর্ণ হয়েছে তাকে ছাড় দিয়ে ফরম ফিলাপ করিয়েছে। যাক কষ্ট দূর করে পুরোদস্তুর পড়াশোনায় মন দিলাম। পরীক্ষা শুরু হলো। সব পরীক্ষা ভালোই হলো। আমি মানবিক বিভাগের ছিলাম। কৃষি বিষয়ে ৪০ নম্বর ছিলো ব্যবহারিক। টাকা ধার্য হলো ২০০। পরীক্ষা শেষে টেনেটুনে ১৫০ টাকা দিলাম এবং সাথে কিছু অনুনয় বিনয়।
২০০০ সালের জুন মাসে রেজাল্ট দিলো। স্কুল থেকে আমিই একমাত্র স্টার মার্কস পেলাম। কিন্তু মার্কশীট আসার পরে দেখতে পেলাম কৃষি শিক্ষার ব্যবহারিকে পেয়েছি ৩৫ কিন্তু যারা ফেল করেছে তারাও পেয়েছে ৪০! আমি ৩৫ পেয়েও কিন্তু লেটার মার্কস পেয়েছি। আমার মার্কস নিয়ে আক্ষেপ নেই। হয়তো যোগ্যতা অনুযায়ী-ই মার্কস পেয়েছি। ২০০৭ সালে সিডরের পর আমাদের গ্রামে যারা সরকারি অনুদানে ঘর পেয়েছেন তাদের কারোই ঘর নষ্ট হয়নি এবং তারা ঐ সময়ে গ্রামে সবচেয়ে সচ্ছল পরিবার ছিলেন।
সম্মান শ্রেণিতে আমি ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট ছিলাম। ৪র্থ বর্ষে ৫০ মার্কসের মৌখিক পরীক্ষা ছিল। সেখানেও আমার মার্কস শীর্ষ ১৫ জনের মধ্যে ছিল না। অথচ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম আমিই হয়েছিলাম। কলেজে যোগদানের পরে দেখেছি অনেক সচ্ছল ও প্রভালশালী লোকজন আর্থিক বেনিফিটের সুপারিশ করানোর জন্য আসেন তখন আমার পিছনের ইতিহাস মনে পড়ে যায়।
আমি শিক্ষক হওয়ার পর আমার শিক্ষার্থীদের বিচার ১০০% সঠিকভাবে করতে না পারলেও বিবেকের তাড়নায় কখনোই যোগ্যকে অবমূল্যায়ন করি না। সারসংক্ষেপ : যে সেবাটা আপনার পাওয়া জরুরি নয়, সেটা নিতে গিয়ে অন্য একজন প্রকৃত সেবাগ্রহীতার প্রাপ্য সেবা হতে তাকে বঞ্চিত করবেন না। স্বজনপ্রীতির দ্বারা অযোগ্যকে মূল্যায়ন করে যোগ্য ব্যক্তির সম্মান নষ্ট করবেন না। সমাজের প্রকৃত অসচ্ছলদের সেবা নিতে সহায়তা করুন।