দুর্নীতিদেশ

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণের আলটিমেটাম দিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণের আলটিমেটাম দিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকার তাঁকে অপসারণ না করলে কীভাবে করতে হবে, সেই পন্থা তাদের জানা আছে। 

জনপ্রশাসন সংস্কারে মুয়ীদ চৌধুরীর একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার রাজধানীতে রীতিমতো ব্যানার টানিয়ে সভা করেন প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে সরকারের প্রতি এমন অবস্থান চাকরিবিধি ও শিষ্টাচারের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা জানিয়েছেন, সংস্কার কমিশনের কাজ এখনও শেষ হয়নি। কমিশনপ্রধানের বক্তব্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও তার বহিঃপ্রকাশ এভাবে করা ঠিক হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এর আগে এক অনুষ্ঠানে প্রশাসন ক্যাডারের এত কর্মকর্তাকে একসঙ্গে কখনোই দেখা যায়নি। বর্তমানে সাড়ে ৫ হাজার প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ব্যানারে তারা রাজধানীতে সমাবেশের পরিকল্পনাও করছেন। 

এর আগে ১৭ ডিসেম্বর এক সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনপ্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী জনপ্রশাসনে উপসচিবদের পদোন্নতি দিতে পরীক্ষা নেওয়া এবং এ পদে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করার সুপারিশ করবেন বলে জানান। 
এর প্রতিবাদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়ম ভেঙে গত রোববার সচিবালয়ে শোডাউন করেন। মাঠে নেমেছেন অন্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারাও। তাদের সংগঠন ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ গত মঙ্গলবার কলমবিরতির নামে এক ঘণ্টা কাজ থেকে বিরত থাকেন। এ ছাড়া আজ বৃহস্পতিবার মানববন্ধন এবং ৪ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। দু’পক্ষকেই  জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। 

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ৩০ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনো আদেশ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো রূপ অসন্তোষ বা ক্ষোভ প্রকাশ বা আন্দোলনে কোনো সরকারি কর্মচারী অংশগ্রহণ করবেন না।’ বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের সবাই কর্মচারী; কর্মকর্তা বলে কিছু নেই। ৩০ ধারার সি উপধারায় বলা হয়েছে, সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনো আদেশ বা সিদ্ধান্ত বদলের জন্য চাপ দিতে পারবেন না কর্মচারীরা। ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার ২(ই) ধারায় এমন আচরণকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেউ তা করলে সরকার তিরস্কার থেকে শুরু করে বরখাস্তের মতো শাস্তি দিতে পারবে। 

তবে গতকাল বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ) আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় এ বিধি মানতে দেখা যায়নি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। রাজধানীর ইস্কাটনে বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে ‘জনপ্রশাসন সংস্কারকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে’ শীর্ষক এ সভায় বক্তব্য দেন প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক-বর্তমান, সিনিয়র-জুনিয়রসহ ২০ জন। তাদের সবার ভাষাই ছিল আক্রমণাত্মক। ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ সংস্কার কমিশনের সদস্যদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। 

তানভীর আহমেদ বলেন, ‘পাঁচজন সাবেক প্রধান বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বিস্তারিত পর্যালোচনা করে রায়ে বলেছেন, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ পদ বৈধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘থানা পরিদর্শন করতে পারতেন ইউএনওরা। আজকের ইউএনওরা কি পারেন সেটা? স্যারই তো ঠিকমতো ডাকে না। আজ জনপ্রশাসনকে দুর্বল করার প্রক্রিয়া কেন? কারণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারা জনপ্রশাসনকে বাইপাস করে সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে।’

সকালে কর্মসূচিতে আসার সময় দায়িত্বশীল পদে থাকা দু’জন ব্যাচমেট কল করে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা না করতে অনুরোধ করেছেন বলে জানান বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি এ বি এম আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘তো আমার মনে হলো, আজকের এই প্রতিবাদ– এটা অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ শুরু করেছে। আমি একটা আগাম প্রস্তাব দিয়ে রাখি। আগামী ৪ জানুয়ারি আপনারা যদি সম্মতি দেন, আমরা একটা মহাসমাবেশ করতে পারি। যেখানে ৫০০ পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে। আজকে হলো ২০০ পাওয়ার, আর ওই দিন দেওয়া হবে ৫০০ পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক। তাহলে আমার মনে হয়, আর অপারেশনের প্রয়োজন হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ষড়যন্ত্র করার জন্য দুটো বিষদাঁত অঙ্কুরিত হয়েছে। এই বিষদাঁতগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। একটা হলো মুয়ীদ ভাই।’ এ সময় মুয়ীদ চৌধুরীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘আমরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই মুয়ীদ ভাইয়ের অপসারণ চাই। সরকার যদি অপসারণ না করে, কীভাবে অপসারণ করতে হবে, সেই কোর্স আমাদের জানা আছে।’

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কোটা প্রথার জন্য এত আন্দোলন হলো, এতগুলো জীবন চলে গেল। অথচ সেই কোটা প্রথা রয়ে গেল! প্রশাসনের ভেতরে দ্বন্দ্ব যাতে না থাকে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনকে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে পেরেছেন? একটি আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রকে এত বড় একটি স্থানে কেন নেওয়া হলো? এটা নাকি সরকারের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি চাপিয়েই দেওয়া হয়, তাহলে মুয়ীদ সাহেব সেটা অস্বীকার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি।’

সবশেষে কর্মসূচি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারের ওপর কোনো রকম সার্জারি চালাতে বা কোটা আরোপ করতে দেব না। কমিশন কোনো অযাচিত সুপারিশ করলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। প্রশাসনের কোথাও বহিরাগত কাউকে এনে বসানোর চেষ্টা করা হলে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত কর্মকর্তাসহ সব কর্মকর্তাকে যথাযথ সম্মানের ব্যবস্থা করে জনপ্রশাসন নিয়ে অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ 

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, ‘সার্ভিস শৃঙ্খলার পরিপন্থি কাজ কোনোভাবেই উচিত নয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কী প্রস্তাবনা দিচ্ছে, তা না দেখেই কর্মসূচিতে যাওয়া ঠিক হয়নি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এটি করা হয়ে থাকতে পারে। যাদের নিজেদের মধ্যে শিষ্টাচার নেই, শৃঙ্খলাবোধ নেই, তাদের কাছে জাতি কী আশা করবে? এসব বিশৃঙ্খলা শক্ত হাতে দমন করা উচিত সরকারের।’

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘যে কেউ দাবি জানাতে পারে। কিন্তু শ্রুতিকটু শব্দ ব্যবহার বা দৃষ্টিকটু আচরণ করা ঠিক না।’ সরকারের করণীয় কী হতে পারে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, কমিশনের অফিস বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। অতীতে এ ধরনের কোনো কমিশনের অফিস সচিবালয়ে ছিল না। তৃতীয়ত, প্রশাসনিক সংস্কারের কাজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নয়; মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। সেখানে সুশাসন ও সংস্কার নামে অনুবিভাগ রয়েছে। চতুর্থত, সব ক্যাডারের অফিসারদের উচিত এখন যার যার কাজে মনোযোগ দেওয়া এবং কমিটিকে নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ করে দেওয়া।’

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান সমকালকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আমাদের গণকর্মচারীদের দলীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী জনপ্রশাসন আর পুলিশ যে স্বাধীনভাবে কাজ করবে– সেটি হয়নি। বরং দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি আর বঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে। পদবঞ্চিতদের অনেক দুঃখ-বেদনা আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মৌলিক এই সংস্কারের প্রয়োজন আছে কিনা– সেটিও একটি প্রশ্ন। আর এতদিন যে প্রক্রিয়ায় পদোন্নতি হয়েছে, তার বিপরীতে গিয়ে সংস্কার করতে চাইলে তো ক্ষোভের মধ্যে পড়তে হবে। তবে যেভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে, সেভাবে না হলেই পারত। যেভাবে হচ্ছে সেটি বিব্রতকর।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button