দেশ

আরও বাজারমুখী হচ্ছে ডলারের দাম, পদ্ধতি নিয়ে প্রজ্ঞাপন হতে পারে আজই

নতুন বছরের শুরু থেকে ডলারের দাম আরও বাজারমুখী করার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন দুপুরের মধ্যে ডলার কেনাবেচার তথ্য সংগ্রহ করবে। এরপর ডলারের মধ্যবর্তী দাম প্রকাশ করা হবে। ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে কেনাবেচা করলে জরিমানা আরোপ করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশে ব্যাংক। জরিমানার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা থেকে লেনদেনের ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করলে তার জন্য নিলাম করবে। আগে শুধু পছন্দের ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করত।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরের মধ্যে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী শীর্ষ ২৫ ব্যাংকের সঙ্গে সভা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব পরিকল্পনার কথা জানানো হয়, যা আজকের মধ্যে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হতে পারে। সভায় উপস্থিত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কিছু ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান যোগ দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

মাঝে এক সপ্তাহে দাম ১২৬-১২৭ টাকায় উঠেছিল। তবে দাম আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। বাজার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে। এভাবে চলতে দিলে দাম সহনীয় হয়ে আসবে।

শেখ মোহাম্মদ মারুফ, এমডি, ঢাকা ব্যাংক

সভায় গভর্নর জানিয়ে দেন, যারা ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের ডলার একই দামে কিনতে হবে। ১১৯ টাকার সঙ্গে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ যুক্ত হতে পারে। কেনা দামের চেয়ে ১ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করা যাবে।

এদিকে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা এক লিখিত বার্তায় জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে প্রবাসী আয় আহরণের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময়ের হার সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা নির্ধারণ করেছে। ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে বিনিময় হার তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

সভায় যা হলো

ডলারের বাজারে প্রায় আড়াই বছর ধরে অস্থিরতা চলছে। মার্কিন এই মুদ্রার দাম এই সময়ে ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ডলার বাজার নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে সংকট না কেটে উল্টো বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাজার স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নেওয়ার পর রিজার্ভ কমে অর্ধেক হয়ে যায়।

সরকার বদলের পর নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি ডলারের দাম ১২০ টাকায় নির্ধারণ করে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন। এতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে ডলারের বাজার। বাড়ে প্রবাসী আয়ও। পতন থামার পর রিজার্ভ এখন বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী দিনে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে। তারই অংশ হিসেবে ডলারের দাম এখনকার তুলনায় আরও কিছুটা বাজারমুখী করতে গতকাল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সভা করে। এতে জানানো হয়, ডলারের জন্য এক দিনেই কোনো কোনো ব্যাংক কারও কাছে ১২০ টাকা, আবার কারও কাছে ১২৭ টাকায় বিক্রি করেছে। এভাবে বাজার চলতে পারে না। সভায় বলা হয়, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় কেনাতেও ডলারের দাম এক হতে হবে। ডলার সংগ্রহে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। ডলারের দাম তদারকিতে নতুন বছরে ব্যাংকগুলো থেকে প্রতিদিন ডলার লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ডলার লেনদেনের তথ্য সংগ্রহে একটি নতুন ছক নির্ধারণ করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ভিত্তিতে মধ্যবর্তী দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। ঘোষিত দামে লেনদেন হচ্ছে কি না, তা প্রতিনিয়ত তদারকি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আমদানি দায় মেটাতে ডলারের সংকট দেখা দিলে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তা নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করবে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন সরকার গঠনের পর ডলারের বাজার অনেকটা স্থির হয়ে আসে। তবে এরপরও দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তদারকি জোরদার করে দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।

ঢাকা ব্যাংকের এমডি শেখ মোহাম্মদ মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর ডলারের বাজার অনেকটা স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। অতিরিক্ত আমদানি দায় পরিশোধের চাহিদা আসায় মাঝে এক সপ্তাহে দাম ১২৬-১২৭ টাকায় উঠেছিল। তবে দাম আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। বাজার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে। এভাবে চলতে দিলে দাম সহনীয় হয়ে আসবে। এতে কেউ ডলার মজুত করে বেশি মুনাফা করার সুযোগ পাবে না।

ডলারের বাজারে অস্থিরতার নেপথ্যে

এদিকে ডলারের বাজারে অস্থিরতার জন্য বেশ কিছু কারণ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র। হুসনে আরা শিখা লিখিত বার্তায় জানান, ডিসেম্বর মাসে নানা ঋণ পরিশোধের সূচি রয়েছে। এ জন্য ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছে, যা আন্তব্যাংক বাজারে ডলারের জোগান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেনি। এ ছাড়া বাংলাদেশের ঋণমান অবনমনের কারণে বৈদেশিক ব্যাংকের সঙ্গে দেশের ব্যাংকসমূহের সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ঋণপত্র খোলা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। আমদানি বিল পরিশোধ বিলম্ব করা সম্ভব হয়নি ও অফশোর ব্যাংকিং ঋণের আন্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

লিখিত বার্তায় আরও জানানো হয়, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বৈদেশিক দেনা পরিশোধসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন ডলারের বাজারে চাপ বৃদ্ধি করেছে। প্রবাসী আয় আহরণে একচেটিয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী ভূমিকা বাজারে বিনিময় হারকে অস্থিতিশীল করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়হীনতার কারণেও ডলার বাজারে অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button