নবী করীম (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ প্রথম অহী
হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সর্বপথম রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট অহী আগমনের সূচনা হয় ঘুমের মধ্যে স্বপন আকারে। স্বপ্নে তিনি যা দেখতেন তা-ই দিবালোকের ন্যায় তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত। কিছুকাল এ অবস্থা চলার পর আপনা থেকেই তাঁর অন্তরে লোকালয় হতে সংস্রব হীন নির্জনে থাকার প্রেরণা উদিত হয়। তিনি মক্কা নগরী হতে তিন মাইল দূরে হেরা নামক পর্বত গুহায় নির্জনে (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) বাস করতে লাগলেন। তিনি পানাহারের জন্য প্রত্যাহ বাড়ি এসে সামান্য কিছু নিয়ে যেতেন এবং তথায় একাদিক্রমে অনেক রাত ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকতেন। কিছুদিন পর পর বিবি খাদীজার সাথে সাক্ষাতের জন্য বাড়ি আসতেন। পুনরায় কিছু পানাহার সামগ্রী নিয়ে একাধারে ইবাদত বন্দেগীতে রত হওয়ার জন্য হেরা গুহায় চলে যেতেন। এভাবে হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকাকালে হঠাৎ একদিন নিকট সত্য আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ মহান আল্লাহর পক্ষ হায় ফেরেশতা জিব্রাঈল (আঃ) অহী নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, (ইয়া) (হে নবী) আপনি পড়ুন। উত্তরে তিনি বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। হুযুর (সঃ) বলেন, এতদ শ্রবনে জিব্রাঈল (আঃ) আমাকে ধার এত জোরে আলিঙ্গন করলেন যাতে আমার কষ্ট অনুভব
হল। আরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বললেন ।
১। (ইকরা) আপনি পড়ুন। উত্তরে আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানি না। এতদ শ্রবণে উক্ত ফেরেশতা পুনরায় আমাকে আলিঙ্গন করলেন। এবারও আমার কষ্ট অনুভব হতে লাগল। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “আপনি পড়ুন”। উত্তরে আমি পূর্বের ন্যায় বললাম, আমি তো কখনো পড়ার অভ্যাস করিনি। এতদ শ্রবণে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তৃতীয় বার আমাকে আলিঙ্গন করে ছেড়ে দিয়ে বললেন-
اقرأ باسم ربك الذي خلق – خلق الانسان من علق – اقرأ وربك الأكرم .
উচ্চারণঃ ইকরা বিসৃমি রাববি কাল্লাজী খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক ইকরা ওয়া রাববা কাল আকরাম”। অর্থঃ পড়ুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি আপনার সৃষ্টিকর্তা, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিনড হতে। পড়ুন
আপনার প্রভু অতি মহান ৷ এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) উক্ত আয়াতসমূহ পাঠ করাতে করতে বাড়ি ফিরলেন। ভয়ে যাঁর হৃদয় ঘর থর করে কাঁপতে লাগল। তিনি সহধর্মিনী খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ-এর কাছে এসে বললেন ملوسی আমারে কম্বল জড়িয়ে দাও। আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও। অতঃপর খাদীজা তাঁকে কম্বল জড়িয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর এ ভাব কেটে গেলে তিনি বিবি খাদীজাকে সব বৃত্তান্ত খুলে বললেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর উপর বিরাট দায়িত্ব অর্পিত হতে যাচ্ছে। তাই তিনি খাদীজাকে বললেন, আল্লাহর শপথ। আমি মনে মনে ভয় করছি, এ বিরাট দায়িত্ব আমি আদায় করয়ে পারব কি-না। তখন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্না খাদীজা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম। কিছুতেই নয়, মহান আল্লাহ আপনাকে কখানা অপদস্থ করবেন না। আল্লাহ আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। কেননা মানবতার চরম উৎকর্ষের মূল সব গুণই আপনার মধ্যে বিদ্যমান আছে। আপনি আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, আত্মীয়তার হক আদায় করেন। এতীম, বিধবা, অন্ধ, খঞ্জ তথা অক্ষমদের খাওয়া পরা ও থাকার বন্দোবস্ত করে থাকেন। বেকারদের কর্মসংস্থান করেন। অতিথি সৎকার করে থাকেন, প্রাকৃতিক দূর্যোগে দুস্থ জনগণের সাহায্যে জীবন উৎসর্গে প্রস্তুত থাকেন (সুতরাং এ অবস্থায় আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই)।
এরূপ সান্ত্বনা দেয়ার পর খাদীজা (রাঃ) হুযুর (সঃ)-কে সাথে করে বংশের মুরব্বী স্বীয় চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেল বিন আসাদ বিন আবদুল ওজজার নিকট নিয়ে গেলেন। যিনি জাহেলিয়াত যুগে নাসরাণী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষায় কিতাব লেখতেন, সুতরাং সুরইয়ানী ভাষার ইঞ্জিল কিতাব হতে তিনি ইবরানী ভাষায় আল্লাহর ইচ্ছায় সামর্থানুযায়ী অনেক কিছু লেখেছেন (এক কথায় তিনি আসমানী কিতাবে পারদর্শী ছিলেন)। তিনি সে সময় খুব বৃদ্ধাবস্থা উপনীত হওয়ায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে চাচাতো ভাই। আপনি আপনার ভাতিজার কথা গুনুন। তখন ওয়ারাকা বিন নওফেল হুযুর (সঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, হে ভাতিজা। আপনি কি দেখতে পেয়েছেন বলুন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললেন, যা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। ঘটনা শুনার পর ওয়ারাকা বিন নওফেল হুজুর (সঃ)-কে বললেন, “ইনি তো সেই মঙ্গলময় বার্তাবাহক জিব্রাঈল ফেরেশতা। যাকে আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর নিকট প্রেরণ করেছিলেন। আফসোস। আপনার সবুওয়াতের প্রচারকালে যদি আমি শক্তিশালী যুবক হতাম, যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম যেদিন আপনার সম্প্রদায় আপনাকে দেশান্তরিত করে ছাড়বে। এ কথা শুনে হুযুর (সঃ) আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, আমার দেশবাসী কি আমাকে বিতাড়িত করবে? উত্তরে ওয়ারাকা বললেন, হ্যাঁ। আপনি যে সত্য ধর্ম নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন আপনার ন্যায় যাঁরা পূর্বে এরূপ সত্য ঘর্ম নিয়ে প্রেরিত হ্যায়ছিলেন, জগদ্বাসী তাঁদের সাথে শত্রুতা না করে ছাড়েনি। আমি আপনার সাথে কথা দিলাম, যদি আমি সেদিন জীবিত থাকি, তা হলে অবশ্যই প্রাণপণে আপনার সাহায্য করব। এ ঘটনার অল্প দিন পরই ‘ওয়ারাকা’ ইন্তেকাল করেন। এর পর প্রায় তিন বছর যাবত অহী বন্ধ ছিল।
অহী বন্ধ থাকাকালীন অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে জাবের বিন আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ) বলেন, রাসুল (সঃ) এ প্রসঙ্গে ফরমান একদা আমি পথ চলার সময় আসমানের দিক থেকে বিকট আওয়াজ শুনতে পেয়ে উপর দিকে নজর করে দেখতে পেলাম, যে ফেরেশতা হেরা পর্বত গুহায় আমার কাছে এসেছিলেন, সে ফেরেশতাই আসমান যমীনের মধ্যখানে একটি চেয়ারে উপবিষ্ট আছেন। তাঁর এ অবস্থা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ার্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে আমি বললাম, তোমরা আমার গায়ে কম্বল জড়িয়ে নাও, গায়ে কম্বল জড়িয়ে দাও। এ অবস্থায় আমার উপর পবিত্র কোরআনের সূরা মুদ্দাসসের হতে ৫টি আয়াত অবতীর্ণ হয়
بايها المدثر – قم فاندر – وريك فكير وتبابك قطهر والرجز فاهجر – 1 / 1
উচ্চারণঃ ইয়া আইউহাল মুদাসসির, কু’ম ফাআনজির ওয়া রাববাকা ফাকাববির ওয়া সিয়াবাকা ফাতোয়াহর ওয়ার রুজযা ফাহজুর।
অর্থঃ হে বসরাবৃত। উঠুন, আপনি লোকদেরকে সতর্ক করে দিন। আপনার প্রভুর মহিমা প্রচার করুন। আপনার পরিচ্ছদ পবিএ করুন এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন। (পারা ২৯, সূরা-৭৪, আয়াত ১-৫)
টিকা। এর পর থেকে তাঁর উপর পর পর অহী অবর্তীর্ণ হতে লাগল।