‘ফ্যাসিবাদের বীজ’ ৭২ সালের সংবিধানেই নিহিত: সংস্কার কমিশন

“১৯৭২ সালে একজন একক ব্যক্তি ও একটি দলকে কেন্দ্রে রেখে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত উত্তরোত্তর স্বৈরতন্ত্রী চেহারা ধারণ করতে করতে অবশেষে বাংলাদেশ জুড়ে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে।”
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ১৯৭২ সালে রচিত দেশের প্রথম সংবিধানের ‘দুর্বলতাকে’ দায়ী করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন।
এই কমিশনের ভাষ্য, “ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানের মাঝেই নিহিত ছিল।”
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে প্রথম ধাপে যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছিল, সংবিধান সংস্কার কমিশন তার একটি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন এই কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন দিয়েছিল। শনিবার পাঁচটি খণ্ডে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও শেষপর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানের মাঝেই নিহিত ছিল। এরই ফলাফল হল প্রতিটি আমলেই ক্ষমতার পূঞ্জীভবন আরও ঘনীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিকতা আরও প্রকট রূপ পেয়েছে, বিচারবিভাগ ক্রমশ বেশি বেশি হারে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, জবাবদিহিতার অভাবে ক্ষমতাসীনদের আর্থিক দুর্নীতি আরও প্রবল চেহারা নিয়েছে।
“একইভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা দল, রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে রুদ্ধ করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করেছে। এভাবে ১৯৭২ সালে একজন একক ব্যক্তি ও একটি দলকে কেন্দ্রে রেখে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত উত্তরোত্তর স্বৈরতন্ত্রী চেহারা ধারণ করতে করতে অবশেষে বাংলাদেশ জুড়ে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে।”
সংসদের মেয়াদ চার বছর করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখাসহ দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মত সুপারিশ করা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
১৪৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ হবে ৪ বছর করে। এ সময় তিনি রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সংসদ নেতা হতে পারবেন না।
এ কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা বলেছেন আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।
পাঁচ খণ্ডের এ প্রতিবেদনের প্রথমেই রয়েছে ভূমিকা, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশসমূহের সারসংক্ষেপ; যা ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে সরকার। এটি তিন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে বিদ্যমান সংবিধানের পর্যালোচনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে সুপারিশসমূহ ও তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে সুপারিশের যৌক্তিকতা।
দ্বিতীয় খণ্ডে ১২১ দেশের সংবিধানের পর্যালোচনার ফল রাখা হয়েছে; তৃতীয় খণ্ডে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটিসহ ব্যক্তির মতামতের সারাংশ রয়েছে; চতুর্থ খণ্ডে কার্যাবহ এবং পঞ্চম খণ্ডে রাজনৈতিক দলের থেকে সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ‘স্বৈরশাসক’ বানিয়েছে
সংবিধান সংস্কার কমিশন বলছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের ক্ষমতা ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে’, আর সেই ব্যবস্থাই প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্বৈরশাসকে’ পরিণত করেছে।
“এই কেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে যেমন সম্প্রীতি নষ্ট করেছে, তেমনি ধ্বংস করেছে ভারসাম্য। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, সকল নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত থাকবে। অনুচ্ছেদ ৭০ প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের নেতা হিসেবে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সকল দলীয় সদস্যদের ভোট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছে।
“হাই কোর্টের বিচারক এবং অধস্তন আদালতের নিয়োগদানও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি করেন। রাষ্ট্রপতি প্রায় সকল কাজই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমের ওপর ন্যায়পালের মাধ্যমে কোনো তদারকির ব্যবস্থাই গড়ে উঠেনি। কার্যকরী ভারসাম্যের অনুপস্থিতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য একটি গুরুতর হুমকিস্বরূপ। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার এত ব্যাপক কেন্দ্রীকরণ তাকে স্বৈরশাসকে পরিণত করেছে।”
এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকার সীমা বেঁধে দেওয়ার যৌক্তিকতায় বলা হয়, “বিদ্যমান সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের উপর কোনো সীমা আরোপ করে না যা রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে এক ব্যক্তির চিরস্থায়ী কর্তৃত্ববাদের সুযোগ সৃষ্টি করে।
“আমাদের সংবিধানে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চাকে বিকশিত করা ও স্থায়ী রূপ দিতে একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা সর্বোচ্চ দুই বারের সীমা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির উপর আরোপিত দুই বারের সীমার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।”
ধর্মনিরপেক্ষতা কেন বাদ
১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সে ধারণা সমাজ ও রাষ্ট্রে ‘বিভক্তি ও বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি করে বলে মন্তব্য করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এটি ১৯৭০ সালের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার বা ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত পাকিস্তানের খসড়া সংবিধানে উল্লিখিত ছিল না। কোনো প্রাক-সাংবিধানিক নথিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শাসননীতি হিসেবে গ্রহণ করার কোনো উল্লেখ ছিল না।
“মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব রাজনৈতিক আলোচনায় ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল একপ্রকার অপরিচিত ধারণা। তবু কোনো অর্থবহ আলোচনা ছাড়াই ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”
কমিশন ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে বলেছে, “বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, এবং অতীতে ফ্যাসিবাদী শাসনের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
“এটি বাংলাদেশের বিদ্যমান বহুত্ববাদী সমাজের ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এবং মূলত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিরোধী। সুতরাং রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।”
বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রয়েছে।
সেই মূলনীতির আলোকে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ করাকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে হয়েছে সংবিধানে।
বিদ্যমান চার মূলনীতির পরিবর্তে পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করেছে কমিশন। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ রাখা হয়েছে।
আরও যা রয়েছে
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের পুনরুদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা কথা সুপারিশে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফেরানোর অংশ হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীক কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে।
বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে বিভাগীয় শহরে হাই কোর্টের এখতিয়ার ও মর্যাদাসম্পন্ন আদালত স্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা’ আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে নয় সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
কমিশনে থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্য।
সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের বাইরে আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাদের মধ্য থেকে ওই সদস্যকে মনোনীত করবেন।