নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে টেকসই জীবিকা

ড. হাজেরা খাতুনঃ
নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নারীশক্তির সঠিক ব্যবহার ও ক্ষমতায়নকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা। “নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে টেকসই জীবিকা” শীর্ষক উপসম্পাদকীয়তে আমরা নারী কর্মসংস্থান, নারী উদ্যোক্তা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সামাজিক ন্যায়বিচার, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) সম্পর্কে আলোচনা করব।
১. নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী অবস্থা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বিভিন্ন মাত্রায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে নারীর প্রতি সামাজিক অনুগ্রহ কম, যদিও কিছু ক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সফল হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে নারীরা কৃষি, শিল্প, সেবা খাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও সামাজিক বাধা, প্রথা এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। (World Bank, 2023)
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নারী কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন পলিসি সফল হতে হলে সরকারী সহায়তা, বিশেষ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন। “Gender Equality and Women’s Empowerment” (UN Women, 2022) পেপারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ তাদের ক্ষমতায়ন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
২. নারীর ক্ষমতায়নে টেকসই জীবিকা কীভাবে কার্যকর?
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য টেকসই জীবিকার নিশ্চয়তা গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই জীবিকা বলতে বোঝায় এমন কর্মসংস্থান, যা দীর্ঘমেয়াদী, পরিবেশবান্ধব, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং নারীকে আঞ্চলিক কিংবা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অবস্থানে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ছোট ছোট নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে, যা তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে। “Microfinance and Women’s Empowerment” (Grameen Bank, 2021) অনুযায়ী, মাইক্রোক্রেডিট নারীদের জন্য তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় বৃদ্ধি করে।
এছাড়া, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি খাতের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার জন্য, উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। “Agricultural Development and Women Empowerment” (FAO, 2020) গবেষণায় দেখা গেছে যে, নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
৩. নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিক্ষা
নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, গণনা, এবং ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জন, নারীদের কর্মসংস্থানের বাজারে তাদের অবস্থান মজবুত করে। “The Role of Education in Women’s Economic Empowerment” (UNESCO, 2022) রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, নারীদের উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
৪. সমাজে নারীর ভূমিকা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার
নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারী, বিশেষ করে গ্রামীণ এবং পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের নারীরা বহু সময় পরিবারিক দায়িত্ব, সাংস্কৃতিক বাধা এবং সামাজিক ব্যবস্থার কারণে নিজেদের যথাযথ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। “Gender and Social Justice” (UN Women, 2023) অনুযায়ী, নারীদের কাজের পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সঠিক প্রতিষ্ঠা হলে, তারা অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
৫. নারীদের জন্য টেকসই জীবিকা তৈরির কৌশল
১. কৃষি ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ: নারীদের জন্য কৃষি ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলির মাধ্যমে টেকসই জীবিকা তৈরি করা যেতে পারে। নারী কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষির নানান কৌশল তৈরি করতে হবে।
২. স্বাস্থ্য ও পরিবহন সেবা: নারীদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা স্থাপন করলে, তারা বেশি সময় কর্মসংস্থানে এবং টেকসই জীবিকা অর্জনে নিয়োজিত হতে পারেন।
৩. নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন: নারী উদ্যোক্তা গড়ে তোলার জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং পুঁজি যোগান দেওয়ার উদ্যোগ গড়ে তোলা যেতে পারে।
৪. মাইক্রোফাইন্যান্স ও ক্ষুদ্র ব্যবসা উদ্যোগ: নারীদের ব্যবসায়িক দক্ষতা অর্জনের জন্য মাইক্রোফাইন্যান্স উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
৬. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs)
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) গুলোর মধ্যে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি মূল লক্ষ্য হিসেবে রয়েছে। SDG 5 অনুযায়ী, “Gender Equality” অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রচেষ্টা চলছে। নারীদের জন্য কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন, বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে টেকসই জীবিকা একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক জরুরি বিষয়। নারীকে সমতা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য এবং ন্যায়বিচারের সুবিধা প্রদান করলে, তারা উন্নতির পথে আরও এগিয়ে যাবে। তাই, সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এবং বেসরকারি খাতগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে, সমাজের উন্নয়নে অংশ নিতে পারে।
লেখক: পরিচালক, আইসিটি বিভাগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন