রমজানের প্রথম পর্ব: পবিত্রতা ও ইবাদত-বন্দেগি

বিল্লাল বিন কাশেম: রমজান হলো মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধির মাস। এই মাসে রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে, যা মুসলমানদের আত্মসংযম ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। রমজান শুধু উপবাস থাকার নাম নয়; বরং এটি ধৈর্য, সংযম, আত্মশুদ্ধি, দানশীলতা ও ইবাদতের মাস। প্রথম রমজানের দিন থেকেই মুমিনদের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, যেখানে তারা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন।
রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত
রমজান মাসের গুরুত্ব আল্লাহ তাআলা স্বয়ং পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন:
“রমজান মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথনির্দেশক ও সুস্পষ্ট সত্য-তথ্যের বিবরণ এবং হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী।” (সুরা বাকারা: ১৮৫)
এ মাসে রোজার মাধ্যমে মানুষ আত্মসংযম শেখে এবং পাপ থেকে বিরত থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি ঈমান ও নিয়তের সাথে রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৮)
রমজানের বিশেষ ফজিলতের মধ্যে অন্যতম হলো—এই মাসে ‘লাইলাতুল কদর’ রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
রমজানের প্রথম দশক: রহমতের সময়
রমজানের প্রথম দশককে ‘রহমতের দশক’ বলা হয়। এই সময়ে আল্লাহর অশেষ করুণা ও দয়া বর্ষিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“এটি এমন একটি মাস, যার প্রথম অংশ রহমত, মধ্য অংশ মাগফিরাত এবং শেষ অংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তি।” (সহিহ ইবনে খুজাইমা)
প্রথম রমজান থেকেই মুমিনদের উচিত—আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য বেশি বেশি ইবাদত করা, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং দান-সদকা করা।
রমজানের প্রথম দিন: প্রস্তুতি ও করণীয়:
১. রোজার নিয়ত ও আত্মশুদ্ধির সংকল্প
রোজার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং আত্মসংযমের অনুশীলন করা। এজন্য প্রথম রমজানের দিন থেকেই নিয়ত করতে হবে যে, এই পুরো মাস আল্লাহর ইবাদতে কাটানো হবে।
২. সাহরি খাওয়া ও নিয়ম মেনে রোজা রাখা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমরা সাহরি খাও; কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯২৩)
সাহরি খাওয়া সুন্নত এবং এটি রোজাদারের জন্য শারীরিকভাবে উপকারী।
৩. নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত বৃদ্ধি
প্রথম রমজানের দিন থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করা উচিত। এছাড়াও, কুরআন তেলাওয়াত করা এই মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
৪. তাকওয়া অর্জনের চেষ্টা
রমজানের উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া হলো আল্লাহর ভয় এবং তাঁর বিধান মেনে চলার শক্তি। রোজার মাধ্যমে মানুষ তাকওয়া অর্জন করতে পারে।
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা বাকারা: ১৮৩)
৫. দান-সদকা বৃদ্ধি করা
রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি দান করতেন। তাই আমাদেরও দরিদ্রদের সাহায্য করা উচিত।
৬. মাগরিবের পর ইফতার ও শোকরিয়া আদায়
রোজাদারের জন্য ইফতারের সময় বিশেষ দোয়া করার সুযোগ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত আছে—একটি ইফতারের সময় এবং অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯০৪)
ইফতার শেষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং এশার পর তারাবিহ নামাজ পড়া উত্তম আমল।
রমজানের আত্মিক প্রভাব
রমজানের প্রথম দিন থেকেই মুসলমানদের হৃদয়ে এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এই মাসে আত্মশুদ্ধির পরিবেশ তৈরি হয়, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
১. আত্মসংযম ও ধৈর্য
রোজার মাধ্যমে মানুষ ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করা শেখে, যা ধৈর্য ও সংযমের শিক্ষা দেয়।
২. পারস্পরিক সহানুভূতি বৃদ্ধি
রমজানে ধনী-গরিবের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। যারা অভুক্ত থাকে, তাদের কষ্ট উপলব্ধি করা সহজ হয়।
৩. গুনাহ থেকে বিরত থাকা
এই মাসে গীবত, মিথ্যা বলা, খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হয়, যা মানুষকে আরও নেককার বানায়।
রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। প্রথম দিন থেকেই বেশি বেশি ইবাদত ও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভের চেষ্টা করা উচিত। এ মাস আমাদের জীবনে পরিবর্তন আনার এক অনন্য সুযোগ, যা শুধু রোজা রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ ও জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আনার মাধ্যম।
আসুন, আমরা প্রথম রমজান থেকেই সংযম, দানশীলতা, তাকওয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে রমজানের ফজিলত লাভের তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: গণসংযোগ কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।