ইসলাম ধর্ম

আজ ইফার ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন : প্রেক্ষিত নতুন বাংলাদেশ

বিল্লাল বিন কাশেমঃ ইসলাম শান্তি, ন্যায় এবং মানবতার ধর্ম। ইসলামের মূল বার্তা হলো, যে কোন ধরনের বৈষম্য, অবিচার ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানবতার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলাম মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের জন্য যথাযথ ভূমিকা পালন করতে চায়। ইসলামের শিক্ষা দেশের শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ, যার শিকড় ইসলামের সুগভীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, সেখানে ইসলামের সঠিক দীক্ষা ও চর্চা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা অর্জনের পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে।

১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশে ইসলামের প্রতিপালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে ইসলামের সঠিক অর্থ এবং শিক্ষার প্রচারসহ ধর্মীয় মূল্যবোধের সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। বিশেষত, স্বাধীনতার পর ইসলামের দিকে মানুষের আগ্রহ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দেখে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা, মুসলিম সমাজের উন্নয়ন, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক মূল্যবোধের সংরক্ষণ একটি নির্দিষ্ট রূপরেখায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাওলানা আবুল হাশিম। তিনি প্রশাসনিক ও গবেষণামূলক কার্যক্রমে অবদান রাখেন। প্রথম দিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সমাজ ও ধর্মীয় জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা, কুরআন ও হাদিসের গ্রন্থ প্রকাশনা, দাওয়াহ কার্যক্রম, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধির জন্য কাজ শুরু করে।

ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভূমিকা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তার অবদান রাখতে শুরু করে ১৯৭৫ সাল থেকে। ১৯৭৮ সাল থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে ইসলামী গবেষণা, ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, শিশু-কিশোরদের ইসলামিক শিক্ষা প্রদান, ইমামদের প্রশিক্ষণ, হজ ব্যবস্থাপনা, ও ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক কাজ শুরু করে। আজ পর্যন্ত এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

১. ইসলামী গবেষণা ও প্রকাশনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কুরআন, হাদিস, ইসলামী ফিকহ, ইসলামী ইতিহাস ও নবীজির জীবন নিয়ে গবেষণা করে এবং প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ করে। তাফসিরুল কুরআন, ইসলামের ইতিহাস, নবীজির জীবন (সীরাহ), হাদিস গ্রন্থ ও সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারা নিয়ে গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে ফাউন্ডেশনটি ইসলামের সঠিক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া, ফাউন্ডেশনটি নানা ভাষায় আল-কুরআনের অনুবাদ ও তাফসির প্রকাশ করেছে, যা দেশের জনগণের জন্য সহজবোধ্য ও উপকারী হয়েছে।

২. মসজিদভিত্তিক শিক্ষা ও শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় শিক্ষাদান
বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কর্মসূচি শুরু করেছে। বর্তমানে এটি দেশের ৬৪টি জেলার ৮৬,০০০ মসজিদে শিশুদের কুরআন শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা প্রদান করছে। শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের ইসলামী শিক্ষা ও কিশোর-কিশোরীদের ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখানো এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য।

৩. ইমাম ও ওলামা প্রশিক্ষণ
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নিয়মিতভাবে ইমাম, খতিব ও ওলামা-মাশায়েখদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে, যাতে তারা আধুনিক চিন্তাধারা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সহনশীল ইসলামী মূল্যবোধ ও সমাজে শান্তির বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যমে সঠিক ইসলাম প্রচার করতে সক্ষম হন। বর্তমান সময়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪টি জেলা ও ৫০টি উপজেলায় ইমাম ও ওলামাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

৪. রমজান, হজ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা
রমজান মাসে ইফতার, তারাবি নামাজ, জাকাত, ফিতরা বিতরণ ও অন্যান্য ধর্মীয় কার্যক্রমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি হজ ব্যবস্থাপনায়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যেমন হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণ ও হজ গাইড প্রকাশ করা।

৫. ইসলামিক অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়ন
ইসলামী অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন সুদবিহীন অর্থনীতি, ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা, ইসলামী ব্যাংকিং, মাইক্রোফাইন্যান্স ও দরিদ্রদের জন্য অর্থনৈতিক সমর্থন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এর মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগণের জন্য ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমর্থন ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আরও উন্নত ও আধুনিক হতে হবে। ডিজিটাল যুগে ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল দাওয়াহ কার্যক্রম ও অনলাইন কোর্স চালু করা প্রয়োজন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনটি ইসলামিক শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারলে বিশ্বব্যাপী ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বার্তা প্রচার সম্ভব হবে।

এছাড়া, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে জনগণের মধ্যে সহনশীলতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছাতে কাজ করতে হবে।

ইমাম ও মুয়াজ্জিন কল্যাণ এবং সুদ মুক্ত আর্থিক ব্যবস্থা
ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা বাংলাদেশের মসজিদে ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সমাজের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা প্রদান করা একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের কল্যাণে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

এছাড়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করে ইমামদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা কেবল ধর্মীয় কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ না থেকে, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নতুন সমাজের চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের আরও দক্ষ করে তুলছে।

ইসলামী মূল্যবোধ এবং ফাউন্ডেশনের সামাজিক কার্যক্রম
ইসলামী মূল্যবোধ শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিক শিক্ষা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফাউন্ডেশনটির মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুরা, কিশোর-কিশোরীরা এবং যুবকরা ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশে ইসলামী সমাজের শৃঙ্খলা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে।

এছাড়া, ইসলামের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা এবং কর্মসূচি, যেমন সুদবিহীন ঋণ সুবিধা, ইসলামী ব্যাংকিং ও মাইক্রোফাইন্যান্স, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের জন্য শক্তিশালী সমর্থন ব্যবস্থা তৈরি করেছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যত করণীয়
নতুন বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাজের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ফাউন্ডেশনকে প্রযুক্তিনির্ভর ইসলামী দাওয়াহ কার্যক্রমে আরও মনোযোগ দিতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা এবং গবেষণা প্রচারের সুযোগ রয়েছে, যা দেশের বাইরে এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছাতে সহায়ক হবে।

এছাড়া, ইসলামের প্রতি ভুল বা একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙে জনগণের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ এবং শান্তির বাণী পৌঁছানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করে ইসলামের সঠিক রূপ তুলে ধরতে সক্ষম হবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ইসলামের ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা পালন করছে। এর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছানোর কাজ চলছে, এবং এর কার্যক্রম সারা বিশ্বে ইসলামের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে। তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আরও আধুনিক, উদ্ভাবনী এবং বিশ্বমানের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যাতে এটি ইসলাম এবং মানবতা প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: গণসংযোগ কর্মকর্তা,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা-১২০৭

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button