পবিত্র রমজানে আমাদের প্রার্থনা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা বন্ধ হোক: ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মাঝে শান্তির বারতা আসুক

লেখক: বিল্লাল বিন কাশেমঃ বিশ্ব আজ এক অশান্ত সময় অতিক্রম করছে। যুদ্ধ, সংঘাত, বৈষম্য ও নির্যাতনের করুণ চিত্র মানবতাকে প্রতিনিয়ত আহত করছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত এক ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এই রমজানের পবিত্র সময়ে, যখন মুসলিম উম্মাহ মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও শান্তির জন্য প্রার্থনা করছে, তখনও গাজা উপত্যকায় ধ্বংসযজ্ঞ চলমান।
শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা, সিরিয়া ও ইয়েমেনের সংকটসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেখা যায়, ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তির বার্তা প্রচার করাই ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। এই উপসম্পাদকীয়তে আমরা কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে শান্তির গুরুত্ব, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের ভয়াবহতা, বিশ্বশক্তির ভূমিকা, শান্তি আলোচনার বর্তমান অবস্থা এবং কীভাবে এই যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করব।
ইসলামের দৃষ্টিতে শান্তি ও যুদ্ধ
ইসলামের মূল শিক্ষা হলো শান্তি ও মানবকল্যাণ। কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
“আর যদি তারা শান্তির দিকে ঝোঁকে, তবে তুমিও তার দিকে ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করো। নিশ্চয়ই তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রবণকারী ও সর্বজ্ঞ।” (সুরা আনফাল: ৬১)
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলাম যুদ্ধকে উৎসাহিত করে না; বরং যেখানে সম্ভব, সেখানে শান্তি স্থাপনের ওপর জোর দেয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে আমরা দেখি, তিনি কখনো অযথা যুদ্ধ করেননি; বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি এর অন্যতম উদাহরণ। মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করলেও রাসুল (সা.) ধৈর্য ধরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
কিন্তু বর্তমান বিশ্বে আমরা ঠিক বিপরীত চিত্র দেখতে পাচ্ছি। যুদ্ধের ফলে নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং পুরো মানবসভ্যতা হুমকির মুখে পড়ছে।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত: একটি মানবিক বিপর্যয়
ফিলিস্তিনের মাটি দীর্ঘদিন ধরে রক্তে রঞ্জিত। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং হত্যাযজ্ঞের এক দীর্ঘ ইতিহাস চলছে। সম্প্রতি গাজার ওপর ইসরাইলের বর্বর হামলা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, কয়েক মাসের মধ্যে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। হাসপাতাল, স্কুল, বাসস্থান—সব কিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে:
“যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে হত্যা করল—এমন ব্যক্তিকে হত্যা ছাড়া অথবা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টির কারণে হত্যা ছাড়া—তবে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই হত্যা করল।” (সুরা মায়েদা: ৩২)
অর্থাৎ, নিরপরাধ মানুষ হত্যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু আজকের বিশ্বে রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে নিরীহ জনগণকে হত্যা করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অমানবিক।
বিশ্বশক্তির ভূমিকা ও শান্তি আলোচনার বাস্তবতা
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের দ্বৈত নীতি দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বড় শক্তিগুলো প্রকাশ্যে ইসরাইলকে সমর্থন জানাচ্ছে। অন্যদিকে, মুসলিম বিশ্ব বিভক্ত ও দুর্বল। কিছু দেশ কূটনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
সম্প্রতি বিভিন্ন শান্তি আলোচনা হয়েছে, যেমন:
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ঘোষণা
কাতার, মিসর ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা
কিন্তু এসব আলোচনা এখনো কার্যকর ফলাফল আনতে পারেনি।
যুদ্ধ কীভাবে বন্ধ হতে পারে?
বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
১. আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি: জাতিসংঘ ও ওআইসি-সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যেন তারা যুদ্ধ বন্ধ করে।
২. রাজনৈতিক সমাধান: দুই-রাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ বের করতে হবে।
৩. মুসলিম বিশ্বের ঐক্য: মুসলিম দেশগুলোর বিভক্তি কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ফিলিস্তিনের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
৪. গণমাধ্যমের ভূমিকা: বিশ্ব মিডিয়ার উচিত নিরপেক্ষভাবে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরা, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবিক সমর্থন জোগায়।
৫. শান্তি আলোচনা ত্বরান্বিত করা: মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর উচিত যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তির জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।
বিশ্ব এখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুধু একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়; এটি মানবতার সংকট। পবিত্র রমজানের এই সময়, যখন আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের আশায় প্রতিটি মুসলিম নতজানু, তখন আমাদের একসঙ্গে প্রার্থনা করা উচিত—যাতে বিশ্ব থেকে যুদ্ধ বন্ধ হয়, নিরীহ মানুষের রক্তপাত বন্ধ হয়, এবং শান্তি ফিরে আসে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ শান্তি ও সমঝোতার পথ নির্দেশ করেন।” (সুরা নাহল: ৯০)
আসুন, আমরা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা বন্ধ করার জন্য সোচ্চার হই। মুসলিম বিশ্বসহ সমগ্র মানবজাতি যেন শান্তি ও ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে যেতে পারে—এটাই হোক আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
লেখক: গণসংযোগ কর্মকর্তা,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা-১২০৭