
মোঃ ইলিয়াস বিন কাশেমঃ রাজনীতি একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা রাষ্ট্রের গঠন, সমাজের উন্নয়ন এবং জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য প্রয়োজন। তবে, বর্তমান সমাজে রাজনীতি অনেকাংশে বিকৃত হয়ে গেছে।
ক্ষমতার দখল, অর্থ উপার্জন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অনেক নেতা রাজনীতিকে এক ধরনের ব্যবসা বা লাভজনক পন্থায় পরিণত করেছেন। এ ধরনের রাজনীতি দেশের সমাজকে বিভক্ত করছে, জনগণের আস্থা নষ্ট করছে এবং সমাজের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে। তাই বর্তমান রাজনীতির ধরন পরিবর্তন করা জরুরি।
প্রকৃত রাজনীতি কখনোই ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়। বরং এটি জনগণের সেবা, সমাজের উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য হতে হবে। রাজনীতি শুধু একটি শক্তির লড়াই নয়, এটি জনগণের বিশ্বাস অর্জন করার একটি পথ।
প্রকৃত রাজনীতি এমন এক প্রকল্প যা জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করে, যাতে তাদের জীবনে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়। এজন্য রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্য হতে হবে জনগণের কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আর্থিক শোষণ প্রতিরোধ করা।
দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে রাজনীতিতে অনেক নেতার আচরণ ও কার্যকলাপ এমন যে, তারা জনগণের ইচ্ছা, চাহিদা এবং স্বার্থের প্রতি কোনও মনোযোগ দেন না। তারা নিজেরাই তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য রাজনীতি ব্যবহার করছেন। পরিবারতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এক ধরনের পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর।
রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী নেতারা যদি নিজেদের দলের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখান এবং ত্যাগী, পরিশ্রমী কর্মীদের অবমূল্যায়ন করেন, তাহলে তা দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দলের জন্য ক্ষতিকর হবে।
রাজনীতি কখনোই ক্ষমতার হাতিয়ার হওয়া উচিত নয়। যদি রাজনীতি একটি পরিবারের হাতে একচেটিয়া হয়ে যায়, তাহলে জনগণ ও সাধারণ কর্মী হতাশ হয়ে পড়েন। একজন নেতা যখন নিজের পরিবারের সদস্যদের ছাড়া অন্যদের অবমূল্যায়ন করেন এবং ত্যাগী, পরিশ্রমী কর্মীদের দূরে ঠেলে দেন, তখন দলের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। এতে, দলের ভেতরকার কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নেতারা যদি শুধুমাত্র নিজেদের পরিবারের পছন্দের ব্যক্তিদের পদপ্রাপ্তির সুযোগ দেন, তবে দলের কাজের মনোভাব হারিয়ে যায় এবং রাজনৈতিক শক্তির জগতেও পরিবর্তন আসতে থাকে।

প্রকৃত রাজনীতি করতে হলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রাখতে হবে। এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে, রাজনীতিবিদরা জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বুঝে তাদের পাশে দাঁড়াবেন। কর্মীদের প্রতি অনুপ্রেরণা, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা রাখতে হবে। ত্যাগী এবং পরিশ্রমী কর্মীদের কখনোই অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। তাদের প্রয়োজনীয় সন্মান এবং সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা দলের জন্য আরও ভালো কাজ করতে পারেন।
রাজনীতিতে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার প্রবর্তনও জরুরি। প্রতিযোগিতা মানে একে অপরকে পিছনে ফেলা বা ধ্বংস করা নয়, বরং এটি মানসিক বিকাশ, সামাজিক উন্নয়ন এবং দলের মেধা ও কৌশল বৃদ্ধির জন্য হওয়া উচিত। রাজনীতির কর্মপরিধিতে হিংসা, ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং অবজ্ঞা ছড়িয়ে পড়লে তা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে এবং জনগণের কাছে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছাবে।
আজকের রাজনীতি যদি ভবিষ্যতে টিকে থাকতে চায়, তবে এটি জনকল্যাণমুখী হতে হবে। জনগণের কল্যাণ ছাড়া কোন রাজনীতি টিকতে পারে না। রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার রক্ষা করা। রাজনীতির কোনো কাজ যদি জনগণের বিপক্ষে চলে, তবে তা দেশ এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর হবে।
রাজনীতি যদি কেবল পরিবারের বা ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার উপায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা দ্রুত জনগণের আস্থা হারাবে। এমনকি এমন রাজনীতি অজস্র বিতর্কের সৃষ্টি করবে এবং দেশের জন্য তা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। রাজনীতিবিদদের উচিত একটি সুনির্দিষ্ট নীতি ও লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করা। তাদের নিজস্বতা এবং আদর্শের ভিত্তিতে নেতৃত্ব প্রদান করা উচিত, যা জনগণের উন্নতি ও কল্যাণে সহায়ক হবে।
রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড থাকা প্রয়োজন। প্রথমত, নেতৃত্বের প্রতি ডেডিকেশন থাকা উচিত। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা বা সদস্য হওয়ার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, তাকে দলের প্রতি পূর্ণ নিষ্ঠা এবং দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, নেতার শিক্ষা এবং পারিবারিক ঐতিহ্যও গুরুত্বপূর্ণ। এটি তার চরিত্রের উন্নতি, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং দলের কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক নেতার নৈতিকতা এবং মানবিক গুণাবলী থাকা উচিত। তার ব্যক্তিগত জীবন এবং কর্মজীবন একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত, যাতে দলের সদস্য এবং জনগণ তার উপর আস্থা রাখতে পারে।
রাজনীতিতে সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং পদ্ধতিগত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাজনীতি কখনোই হ্যান্ডম, গ্যাংস্টার, মাস্তানি এবং কটুক্তি মার্কা হয়ে উঠতে পারে না। বরং, এটি একটি পরিশীলিত এবং মার্জিত প্রক্রিয়া হতে হবে। রাজনীতির নতুন দিগন্তে প্রবেশ করতে হলে, নেতাদের অহংকার পরিহার করতে হবে এবং বিনয়ী হতে হবে। এ ছাড়া, তাদের উচিত অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদেরকে সমর্থন করা।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের অসম্মান এবং লাঞ্ছিত করার পরিকল্পনাকারী নেতারা কখনোই দেশের সেবক হতে পারেন না। তাদের রাজনৈতিক জীবনের কোনো মূল্য থাকবে না। রাজনীতিতে যারা নৈতিকতা ও মানবিকতার আদর্শ নিয়ে কাজ করেন, কেবল তারা জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হন। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ বা হত্যাকারীদের কখনোই রাজনীতিতে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। বরং, একে অপরকে সহযোগিতা, সমর্থন এবং শক্তিশালী নেতৃত্বের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
সর্বোপরি, রাজনীতি কখনোই ব্যক্তি বা পরিবারের উন্নয়ন নয়, বরং এটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন হতে হবে। যারা অতীতের রাজনীতির ধরন এবং ফরমেট অনুসরণ করতে চান, তারা একদিন পতিত হয়ে যাবেন। আধুনিক রাজনীতি জনকল্যাণের জন্য হতে হবে এবং এটি ভবিষ্যতে দেশের উন্নতি এবং কল্যাণ নিশ্চিত করবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুধু জনগণের সেবা, তাদের কল্যাণ, এবং দেশের শক্তিশালী ভবিষ্যতের জন্য হওয়া উচিত।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং একটি শক্তিশালী, সুস্থ সমাজ গঠনে অবদান রাখতে হবে। রাজনীতি মানুষের জন্য, সমাজের জন্য এবং রাষ্ট্রের জন্য হতে হবে। রাজনীতির শক্তি একমাত্র তখনই কাজে আসবে যখন তা জনগণের সেবা করবে এবং দেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক শিক্ষার্থী লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।