বিশ্লেষণমতামত

মানবজীবন: এক মহাপরিকল্পনার অভিযাত্রী

বিল্লাল বিন কাশেমঃ মানুষের জীবন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান রব আমাদের এক মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যার গন্তব্য নির্ধারিত, যার পথচলা পূর্বনির্ধারিত, আর যার প্রতিটি ধাপ এক অদৃশ্য জ্ঞানের আলোকে পরিচালিত। আমাদের জন্ম, মৃত্যু, জীবনসংগ্রাম, সুখ-দুঃখ, সফলতা-ব্যর্থতা—এসব কিছুই এক মহান পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা মাত্র। এই মহাপরিকল্পনায় আমাদের করণীয় কী? কীভাবে আমরা আমাদের জীবনকে গড়ে তুলব? কীভাবে সঠিক পথ নির্বাচন করব? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

মানবজীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য
আমরা কোথা থেকে এলাম, কেন এলাম এবং কোথায় যাব—এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের জীবন পরিচালনার মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য।” (সুরা আদ-ধারিয়াত, আয়াত: ৫৬)

অর্থাৎ আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা শুধু ইবাদত-বন্দেগিতেই সীমাবদ্ধ থাকব। বরং আমাদের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি জীবনধারা যেন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হয়, সেটাই মুখ্য। কর্মজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক দায়িত্ব—সবকিছুতেই আল্লাহর বিধান মেনে চলাই প্রকৃত সফলতা।

সফর: দুনিয়া থেকে আখেরাতের পথে
মানবজীবন এক সফর, যেখানে আমরা চিরস্থায়ী জীবনের দিকে যাত্রা করছি। আমাদের এই সফরে নানা চ্যালেঞ্জ আসবে, নানা বিপদ আসবে, কখনো সফলতা আসবে, আবার কখনো ব্যর্থতা। কিন্তু এগুলো কেবলই এক পরীক্ষার অংশ।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, জীবন ও ফলফসলের ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।” (সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৫৫)

এই পরীক্ষা কখনো কষ্টের, কখনো স্বস্তির। কেউ বিপদে পড়ে ধৈর্য হারায়, আবার কেউ সাফল্যে অহংকারে মত্ত হয়। কিন্তু প্রকৃত সফল সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল থেকে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে।

আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
মানুষ হিসেবে আমাদের কতগুলো মৌলিক দায়িত্ব রয়েছে, যা পালন করা অত্যাবশ্যক।

১. আত্মশুদ্ধি ও আত্মবিশ্বাস গঠন
আমাদের জীবন যেন লক্ষ্যহীন ও উদ্দেশ্যহীন না হয়। প্রতিটি দিন যেন আমাদের আত্মশুদ্ধির একটি ধাপ হয়। আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং তাঁর পথ অনুসরণ করাই আমাদের প্রধান কর্তব্য। আমরা যদি নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করতে পারি, তাহলে আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত সঠিক হবে, প্রতিটি কাজ কল্যাণকর হবে।

২. দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের প্রস্তুতি
আমরা দুনিয়াতে এসেছি পরীক্ষার জন্য, কিন্তু দুনিয়ার জীবনই চূড়ান্ত গন্তব্য নয়। তাই আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে এমনভাবে, যাতে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় দিকেই সফল হতে পারি।

৩. ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা চর্চা
জীবনের পথচলায় আমাদের ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে হয়। দুঃখ-কষ্ট আমাদের নিরাশার দিকে ঠেলে দেয়, কিন্তু একজন মুমিন সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে।

রাসুল (সা.) বলেছেন:

“মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর! তার সমস্ত বিষয়ই কল্যাণকর। কারণ, সে যদি আনন্দ লাভ করে, তবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে—এটি তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি কষ্টে পড়ে, তবে ধৈর্য ধারণ করে—এটিও তার জন্য কল্যাণকর হয়।” (সহিহ মুসলিম: ২৯৯৯)

৪. সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা
জীবনে কখনো কখনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করতে চাই, তবে আমাদের আল্লাহর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। মহান রব আমাদের প্রতিটি কাজে সাহায্য করেন, যদি আমরা তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“যারা আমার পথে চেষ্টা করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথ দেখিয়ে দেব।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৯)

৫. মৃত্যু ও পরকালের কথা স্মরণ রাখা
আমাদের জীবন ক্ষণস্থায়ী। আজ আছি, কাল নেই। তাই আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত যেন মূল্যবান হয়, প্রতিটি কাজ যেন পরকালকে সামনে রেখে করা হয়।

রাসুল (সা.) বলেছেন:

“এই দুনিয়াতে তুমি এমনভাবে থাকো, যেন তুমি একজন পথিক বা আগন্তুক মাত্র।” (সহিহ বুখারি: ৬৪১৬)

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা: সঠিক পথে থাকার দোয়া
আমরা সবসময় আল্লাহর কাছে সঠিক পথে থাকার জন্য দোয়া করতে পারি। আমাদের চলার পথ সহজ করে দেওয়ার জন্য, ভুল সিদ্ধান্ত থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁর সাহায্য চাওয়া উচিত।

রাসুল (সা.) আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া শিখিয়েছেন:

“হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আমার দৃষ্টির ভুল থেকে রক্ষা করো, আমার অন্তরকে পবিত্র করো, আমার চিন্তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করো, এবং আমাকে তোমার পথে দৃঢ় রাখো।”

আমাদের জীবন এক মহাপরিকল্পনার অংশ। আমরা সবাই সেই সফরের যাত্রী, যার শেষ ঠিকানা আমাদের রবের কাছে। এই পথচলায় আমাদের দায়িত্ব হলো আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা, ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ হওয়া, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য কাজ করা।

আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের ঈমানের ওপর দৃঢ় রাখেন, আমাদের চলার পথ সহজ করে দেন, এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার চূড়ায় পৌঁছানোর তাওফিক দান করেন। আমিন।

লেখক: কবি, প্রবন্ধকার ও গল্পকার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button