ইসলাম ধর্ম

ভয় ও সাহসের দ্বন্দ্ব: আত্মজয়ের পথচলা

বিল্লাল বিন কাশেমঃ মানুষের মন এক বিস্ময়কর জগত। এই জগতে একদিকে ভয়, অন্যদিকে সাহস পাশাপাশি বসবাস করে। কখনো আমরা ভীতু হয়ে যাই, আবার কখনো এমন অদম্য শক্তির প্রকাশ ঘটে যে নিজের ভেতরেই বিস্মিত হয়ে যাই। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। কখনো ভয় আমাকে গ্রাস করে ফেলে, আবার কখনো এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে পেয়েছি, যেখানে চরম সাহসী মানুষরাও ভেঙে পড়েছে, অথচ আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম অবিচল। এই দ্বৈত সত্তা আমার ব্যক্তিত্বেরই অংশ, যা আমাকে ক্রমাগত নতুন করে শিখতে ও নিজেকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

আমার মতো অনেকেই হয়তো এই অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত। জীবনের কঠিন বাস্তবতা আমাদের কখনো দুর্বল করে তোলে, আবার কখনো ভেতরের লুকিয়ে থাকা সাহসকে জাগিয়ে তোলে। প্রশ্ন হলো—এই দ্বৈত সত্তা আমাদের জন্য আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ?

ভয়ের মানসিকতা: একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি
ভয়কে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটি এক স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি। ভয় আমাদের সতর্ক করে, বিপদ থেকে বাঁচার সংকেত দেয় এবং সঠিক সময়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে। ভয় না থাকলে মানুষ হয়তো আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভবই করত না। কিন্তু যখন এই ভয় আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তখনই এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের সমাজে ভয় দেখানো হয় নানা কৌশলে। ছোটবেলায় বাবা-মা শাসন করতে গিয়ে ভয় দেখান, স্কুলে শিক্ষকরা ভয় দেখান, কর্মস্থলে বস ভয় দেখান, এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও জনগণকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলে ভয় একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়, যা আমাদের চিন্তা ও মনোবলকে দুর্বল করে তোলে। কিন্তু ভয় জয় করার শিক্ষা কি আমরা পাই? সাধারণত না। বরং আমাদের শেখানো হয়, ভয় পাওয়া স্বাভাবিক এবং তা মেনে নিতেই হবে।

সাহস: অন্তর্নিহিত শক্তি ও বিকাশের গল্প
যদিও ভয় আমাদের জীবনের এক বাস্তব অংশ, তবুও মানুষ তার সাহস দিয়েই এগিয়ে যায়। ইতিহাসে যারা সত্যিকার অর্থে বড় পরিবর্তন এনেছেন, তারা ভয়কে জয় করেই সফল হয়েছেন।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলি—অনেক সময় মনে হয়েছে, এবার বুঝি আর পারব না। কিন্তু সেই মুহূর্তে যখন সবকিছু হারানোর ভয় মনকে দুর্বল করে ফেলতে চেয়েছে, তখনই এক অব্যাখ্যাযোগ্য শক্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। সেই শক্তি কোথা থেকে আসে? হয়তো নিজের বিশ্বাস, আত্মসম্মানবোধ কিংবা আত্মজিজ্ঞাসা থেকেই।

আমরা যদি আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো, সাধারণ মানুষের মধ্যেও অসাধারণ সাহসের প্রকাশ ঘটে। একজন মা সন্তানের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, একজন কৃষক প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে জমিতে কাজ করেন, একজন চিকিৎসক মহামারির সময় নিজের জীবন বাজি রেখে রোগীদের সেবা দেন। এসবই সাহসের প্রকাশ।

ভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই: ব্যক্তিগত ও সামাজিক বাস্তবতা
ভয়কে জয় করতে হলে প্রথমে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, ভয় আমাদের মধ্যে আছে। এটি লুকিয়ে রাখার কিছু নেই। বরং এই স্বীকৃতিই আমাদের প্রথম ধাপ।

১. আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা
আমরা যখন নিজেদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যে বিশ্বাস করতে শিখি, তখন ভয় দুর্বল হয়ে যায়। সাহসী হওয়ার জন্য সবসময় বড় কিছু করতে হয় না। ছোট ছোট সিদ্ধান্তেও সাহসের প্রয়োজন হয়। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা, ভুল করলে সেটাকে মেনে নিয়ে শেখা, এবং অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া—এসবই সাহসের চর্চা।

২. ভয়কে মুখোমুখি দেখা
আমরা ভয়কে যত এড়িয়ে চলতে চাই, ততই সেটা আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ভয়কে মোকাবিলা করলেই কেবল সেটা কমতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, অনেকে জনসমক্ষে কথা বলতে ভয় পান। কিন্তু ধীরে ধীরে এর অনুশীলন করলে এই ভয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

৩. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা
সাহসী মানুষদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা প্রতিটি পরিস্থিতিতে ইতিবাচক কিছু খুঁজে নিতে পারেন। ব্যর্থতা তাদের দমিয়ে দেয় না, বরং শিখতে সাহায্য করে।

৪. নৈতিক শক্তির চর্চা
যে কোনো পরিস্থিতিতে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সমাজে অনেকেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে, কারণ তারা ভয় পায়। কিন্তু যারা সত্যের পথে অবিচল থাকে, তারাই প্রকৃত সাহসী।

ভবিষ্যতের পথচলা: সাহসকে সঙ্গী করা
আমরা সবাই চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ দিনগুলো যেন সাহসের আলোয় আলোকিত হয়। কিন্তু সাহস কোনো অলৌকিক শক্তি নয়, বরং এটি ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে। জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য একেকটি শিক্ষার সুযোগ।

আমি চাই, সামনের দিনগুলোতে ভয় যেন আমাকে আর দুর্বল করতে না পারে। আমি চাই, সাহস আমাকে শক্ত রাখুক, ন্যায়ের পথে পরিচালিত করুক। পরম করুণাময়ের দয়া যেন আমাকে এমন এক মানসিকতা দান করে, যেখানে ভয় থাকবে নিয়ন্ত্রিত, আর সাহস থাকবে অটুট।

আমার এই দ্বৈত সত্তা—ভয় এবং সাহস—দুটোই আমার জীবনের অংশ। আমি জানি, ভয় থাকবে, কিন্তু সেটাকে জয় করাই হবে আমার আসল পরীক্ষা। সাহস যেন আমাকে পথ দেখায়, সাহস যেন আমাকে সত্যের পথে অবিচল রাখে। এটাই আমার চাওয়া, এটাই আমার সংকল্প।

লেখক: কবি, গবেষক ও গল্পকার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button