এক্সক্লুসিভ

রাজধানী ঢাকা শহর কি তবে আর আমার নয়?

বিল্লাল বিন কাশেমঃ ঢাকা শহরের রাস্তায় রিকশার ঘন্টাধ্বনি আমার কানে এখনো বাজে, যদিও সেই রিকশা এখন আগের মতো নেই। একসময় রিকশাই ছিল আমার প্রিয় বাহন। থ্রি-হুইলারের স্কুটারগুলো চলত, তাদের কালো ধোঁয়া চোখে লাগলেও শহরটা তখন এতটা বিষাক্ত ছিল না। মায়ায় মোড়া ছিল সেই সময়ের ঢাকা। ঈদের দিনে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতাম, বন্ধুরা মিলে পুরান ঢাকার সরবতে চুমুক দিতাম। মনে হতো, এই শহরটাই আমার, আমাদের।

আমার শৈশবের স্মৃতিতে ফার্মগেটের অলিগলি, নিউমার্কেটের ব্যস্ততা, আলাউদ্দীন সুইটমিটের রসগোল্লার স্বাদ এখনো লেগে আছে। আম্মার হাত ধরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফার্মগেট আসতাম চিকিৎসার জন্য। সেই আসা-যাওয়ার পথেও কত মানুষজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় হতো, অপরিচিতরাও আপন হয়ে উঠত। ঢাকার মানুষ তখন সহজ-সরল ছিল, একে অপরের খোঁজখবর নিত।

কিন্তু আজ? আজ পাশের ফ্ল্যাটের মানুষটার নামও জানি না। কয়েক বছর ধরে একই বিল্ডিংয়ে থেকেও কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। ব্যস্ততা, অবিশ্বাস আর নিরাপত্তাহীনতার এক কঠিন দেয়াল আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। ঢাকার ঐতিহ্য আছে, সৌন্দর্যও আছে, কিন্তু নেই সেই আত্মীয়তা, নেই সেই প্রাণ।

দুই
একটা সময় ছিল, যখন ঢাকাকে স্বপ্নের শহর বলা হতো। উন্নত শিক্ষা, চাকরির সুযোগ, বড় হাসপাতাল—সবই ছিল এখানে। কিন্তু আজ এই শহর যেন শুধুই এক কংক্রিটের খাঁচা, যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশচুম্বী, যানজট অসহনীয়, আর নাগরিক সুবিধা বলতে কিছুই নেই।

এক সময় মধ্যবিত্তরা একটু কষ্ট করেও ভালোভাবে চলতে পারত। এখন সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা। এক মাসের বেতনের প্রায় অর্ধেক চলে যায় বাসাভাড়ায়। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ—এসবের বিলও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।

ঢাকায় যারা চাকরি করেন, তাদের বেশিরভাগই এই খরচ মেটাতে হিমশিম খান। একজন নতুন চাকরিজীবী ৩০,০০০ টাকা বেতন পেলেও তার সবটাই চলে যায় টিকে থাকার লড়াইয়ে। বাড়িভাড়া, খাবার, চিকিৎসা—সব মিলিয়ে ঢাকায় জীবনযাপন এখন এক দুঃস্বপ্ন।

তিন
ঢাকা এখন শুধুই যানজটের শহর। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নামে, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগে দ্বিগুণ, কখনো তিনগুণ। গণপরিবহন ব্যবস্থা বেহাল, রাস্তা সংকীর্ণ, আর ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলছে।

মেট্রোরেল চালু হয়েছে, তাতে কিছুটা সুবিধা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা তো পুরো শহরের জন্য নয়। এখনো ঢাকার অধিকাংশ মানুষকে দিনের কয়েক ঘণ্টা যানজটে কাটাতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে ঢাকায় বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। কিন্তু এই ক্ষতির দায় কে নেবে?

এ শহরে ট্রাফিক আইন কেউ মানতে চায় না। ফুটপাতে হাঁটা যায় না, রাস্তায় নামলেই কেবলমাত্র কোলাহল আর ধুলোবালি। মনে হয়, পুরো শহরটাই এক বিশৃঙ্খল ধাঁধাঁ।

চার
জীবনের সবকিছুই কি এত কঠিন হয়ে যাবে? শুধু বাসাভাড়া বা যাতায়াত নয়, ঢাকায় খাবারের দামও এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। আগে যেখানে ৩০-৪০ টাকায় একবেলা খাওয়া যেত, এখন সেটার জন্য ৮০-১০০ টাকা লাগে। বাজারে মাছ-মাংসের দাম সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও খরচ বেড়েছে। স্কুল-কলেজে ভর্তি ফি বেড়েছে, কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন এখন মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতা হয়ে গেছে। ভালো মানের শিক্ষা পাওয়া এখন শুধুমাত্র ধনীদের জন্য সংরক্ষিত।

চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সরকারি হাসপাতালে জায়গা পাওয়া কঠিন, আর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে মোটা অঙ্কের টাকা লাগবে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার খরচ চালানোই যেন এক যুদ্ধ।

পাঁচ
এত কষ্টের মধ্যেও মানুষ ঢাকাকে ছাড়তে পারে না। কেন? কারণ এই শহরেই কাজের সুযোগ আছে, উন্নত জীবনের স্বপ্ন আছে। তবুও প্রশ্ন জাগে—এই স্বপ্ন কি শুধুই মরীচিকা?

যদি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা না বাড়ে, যানজট কমানো না যায়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে না আনা হয়—তাহলে এই শহর সত্যিই একসময় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

আমার সেই পরিচিত ঢাকা, যেখানে মানুষ একসঙ্গে হাসত, উৎসব করত, প্রতিবেশীরা একে অপরের পাশে দাঁড়াত—সেই ঢাকা কি আর নেই? নাকি আমরা এখনো সময় থাকতে এর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারি?

এই শহর কি তবে আর আমার নয়?

লেখক: কবি, প্রবন্ধকার ও গল্পকার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button