শ্রাবণী হত্যাকান্ডে জড়িতরা পার পাবার পথে সিআইডি অফিসারের ঘুষ বাণিজ্যে সর্বসান্ত বাদীর পরিবার

বিশেষ প্রতিনিধি: খুনীদের সবার নাম দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ঘুস নেওয়া হয় তিন দফায় কয়েক লাখ টাকা ঘুস নেওয়ার অভিযোগ তদন্তের নামে সময় বাড়ানোর পর চতুর্থ দফায় ঘুসের দাবী আরো বাড়ে চাহিদামত টাকা না দিলে বিপক্ষে চার্জশীট দেওয়ার হুমকি দেয় সিআইডি
গোপালগঞ্জের আলোচিত শ্রাবণী হত্যা মামলা যার নম্বর জিআর ৯২/২৩ প্রভাবিত হয়ে অন্যদিকে যাবার এক পর্যায়ে দায়িত্বভার সিআইডিকে দেওয়া হয়। জানাগেছে, সিআইডিতে আসার পর পুনরায় লাশ উঠিয়ে তদন্ত এবং সুরতহাল দেখে এটি হত্যাকান্ড হিসেবে প্রকাশ পেলে মামলাটি নতুন মোড় নেয়। এরপর এর সাথে কেকে জড়িত রয়েছে তা তদন্ত চলছে কয়েকমাস ধরে। কিন্তু অভিযোগ ঊঠেছে অতি আবেগপ্রবণ এবং সারল্যের সুযোগে হত্যার শিকার শ্রাবনীর মা’র কাছ থেকে খুনীদের সবাইকে জড়িত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও এদের সঠিক বিচারের আওতায় আনতে সিআইডির তদন্তকারী অফিসার ফরহাদ নিজে এবং অন্যের মাধ্যমে তিন দফায় বাদীর কাছ থেকে প্রায় কয়েক লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে। বাদী শ্রাবনীর মা’র মতে, তার মেয়েকে মারার সাথে যারা জড়িত তাদের সম্পর্কে তদন্ত অফিসার তদন্ত করেই জেনেছেন। আসামীরা আমার বাড়ীর আসপাশ দিয়ে ঘোরে। কিন্তু সত্য ঘটনা অনুযায়ী এদের নামে চার্জশীট না দিয়ে তদন্তের কথা বলে শুধু সময় বাড়াচ্ছেন আর ঘুরাচ্ছেন। সম্প্রািত তিনি আদালতে এবিষয়ে তাগিদও দিয়েছেন। তার মতে, তিনবার কয়েক লাখ টাকা দেওয়ার পর এখন চতুর্থ দফায় আবারও বড় অঙ্কের টাকা খরচ লাগবে বলে জানিয়েছেন, নইলে তিনি বিপক্ষে রিপোর্ট দেওয়ার ভয় দেখান।
ঘটনার গোড়ায় গেলে দেখা যায়, গ্রামের অতি সাধারণ ও নিরীহ পরিবারের কিশোরী মেয়ে শ্রাবণী বিয়ের কিছু দিন পর ২৭ মার্চ ২০২৩ সালে রাতে স্বামী, শশুরবাড়ীর লোকজনের দ্বারা হত্যার শিকার হয়। বাপ বিদেশে থাকায় এমন পরিস্থিতিতে পাড়াগায়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে শ্রাবণীর সহজ-সরল মা ও পরিবারের অন্যরা। হিংস্র পরিবার হিসেবে শ্রাবণীর শশুরবাড়ী চিহ্নিত ছিলো এবং আগেও এধরনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাবার গল্প রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। পাশের এই গ্রামে তাদের নতুন বসতি এবং অনেকটা একাকী ও নিভৃতে থাকে এরা। তার স্বামীর মাদকাসক্ত’র অভিযোগ ছিলো এবং এসব অবস্থার প্রেক্ষিতে শ্রাবণী শশুরবাড়ীর প্রতি সন্তষ্টও ছিলোনা ও যেতে চাইতো না। এমন কি হত্যাকান্ডের রাতের আগের দিন বাপের বাড়ী থেকে রোজারত অবস্থায় তার স্বামী তাকে এসে নিয়ে যায়। এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে গ্রামের প্রায় সবাই জানে। তদন্তের জন্য যখন যিনি এসেছেন গ্রামের সবাই তাদের কাছে একই সাক্ষ্য দিয়েছে। একাধিকবার টাকা দিয়ে মিটমাট করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে এর শশুরবাড়ীর লোকজন। কিন্তু মেয়ের হত্যার বিচারে অনড় রয়েছে বাদী মা। আপোস মীমাংসার টাকা থানা পুলিশ, কোর্ট কাচারিতে ঢেলে পার পেয়ে যাবার হুমকি দিয়ে লড়ে যাচ্ছে তারা।
গ্রাম থেকে নির্ভযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, রক্তাক্ত জামাকাপড় খুলে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে ভ্যানে করে লাশটি কয়েকটি স্থানে ফেলে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় যাতে ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘোরে। এটাকে গলায় দড়িদিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোরও পায়তারা করছে নানাভাবে। জানাগেছে, শ্রাবণীর শশুরবাড়ীর কোনো এক আত্মীয় প্রশাসনে রয়েছেন। যিনি এদের পক্ষে টাকা ছড়িয়ে তদবিরের মাধ্যমে হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য যুক্ত রয়েছেন। যেখান থেকে ভয়াবহ ঘটনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে পার পেয়ে যাওয়ার লাইনে। সাথে রয়েছে মাস্টারমাইন্ড আত্মীয় এবং ঘটনার সহযোগী ছানোয়ার ব্যাপারী। যাদের প্রভাবে প্রথমে থানা পুলিশ, এরপর মর্গ, এরপর পিবিআই এবং পরবর্তীতে সিআইডিতে এসে মামলাটি তালকানা হয়ে ঘুরছে। আর হত্যাকান্ডে প্রধাণ অভিযুক্তরা চক্কর দিয়ে চিকন হুমকি দিচ্ছে শ্রাবণীর বাপের বাড়ীর লোকজনের নাকের ডগায় ঘুরে। সবার মনে একই প্রশ্ন, আলোচিত শ্রাবণী হত্যাকান্ডের বিচার কি আড়ালে পড়ে যাবে।
বিগত ১৯/৫/২০২৪ তারিখে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ এর তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃক স্বাক্ষরিত ভিসেরা রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, শ্রাবণী আক্তার (১৯) আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ভিসেরা রিপোর্টেও নিম্ন লিখিত মতামত প্রদান করা হয়, শ্রাবনী আক্তার আত্বহত্যা করেনি। তদন্তকালে সুরতহাল রিপোর্ট ও ভিসেরা রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায় ভিকটিমের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ৫টি জখমের চিহ্ন ছিল। জানা যায়, বাদী সহ অন্যান্য সাক্ষীদের এর জবানবন্দিতে জানা যায় ভিকটিম আত্মাহত্যা করেনি, যৌতুকের জন্য আসামীরা প্রায়ই শারীরিকভাবে মারপিট করত, ঘটনার দিন ডিসিস্ট শ্রাবনী আক্তারকে মারপিট করা হয় মর্মে সাক্ষ্য ও তথ্য প্রমাণ পাওয়া পেয়েছে। এ বিষয়ে ২৭ তারিখে মুকসুদপুর থানায় ৩০২/৩৪ প্যানাল কোড রুজু হয়। যার মামলার নাম্বার ২৯। আসামীরা হলেন ১। হাসান বেপারী (২৩), ২। শাহাদাৎ বেপারী (২৮), উভয় পিতা- তারা মিয়া বেপারী, ৩। তারা মিয়া বেপারী (৫৫ পিতা- মৃত জয় বেপারী, ৪। হেনা বেগম (৪২) স্বামী-তারা মিয়া বেপারী, ৫। মিতা বেগম (২০) স্বামী- শাহাদাৎ বেপারী, সর্বসাং- সৈদ্দী, ৬। ছনিয়া বেগম (২৫), স্বামী- দেলোয়ার শেখ, সাং- মোল্লাদী, সর্ব থানা- মুকসুদপুর, জেলা-গোপালগঞ্জ ও ৭। মনিকা বেগম (২৮), স্বামী- মোঃ জিলুর রহমান, সাং-হাজরাকান্দা, থানা-ভাংগা, জেলা: ফরিদপুর।
বিষয়টি নিয়ে, কথা বলতে একাধিকবার ফোন করা হলেও সিআইডির তদন্ত অফিসার ফরহাদ ফোন ধরেননি। গোপালগঞ্জের সিআইডি অফিসের দায়িত্বে থাকা রজব আলী জানান, আমি এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। আমি কিছুদিন পর রিটায়ার্ড করবো। সাত তারিখে নতুন এসপি সাহেব আসবেন, এটি তার কাছে জানতে চাবেন। তিনি বলেন, অফিসার ফরহাদের সাথে দেখা হলে আমি বিষয়টি জিজ্ঞাসা করবো। সিআইডি ঢাকা বিভাগের ডিআইজিকে এবিষয়ে জানান হলে তিনি মামলার নম্বর নেন এবং তদন্ত অফিসারকে ডেকে এবিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
মামলার বাদী জানান, সিআইডিতে মামলাটির তদন্তভার দেওয়ার পর কিছু বিষয় দেখে আমরা আশাবাদী ছিলাম যে সত্য ঘটনা প্রকাশ পাবে ও আমরাও মেয়ে হত্যার বিচার পাবো। সঠিক বিচারের জন্য ফরহাদ স্যার আমাদের যা যা করতে বলছেন আমরা তাই তাই করেছি। আমরা শুধু বলেছি, স্যার, আপনিতো জানেন আমার মেয়ে ওরা মেরে ফেলেছে। আমি আর কিছু চাইনা, মরার আগে মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে চাই। টাকা দিতে দিতে আমরা এখন নিঃস্ব। আমাদের দিকে একটু ফিরে চান। কিন্তু তিনি এখন যা দাবী করতেছেন তা আমাদের সাধ্যের বাইরে। এত টাকা আমরা কিভাবে জোগাড় করবো। আমরা তো পথের ফকির হবার অবস্থা। আমার মেয়েও মাইরা ফেলাইলো, বিচার চাইতে এসে টাকা দিতে দিতে হয়ে গেলাম সর্বসান্ত। তিনি আশঙ্কাা করে বলেন, তার কথা না শুনলে তার কথার যে ভাব, তাতে আমাদের বিপক্ষে গিয়ে, তিনি সত্য রিপোর্ট নাও দিতে পারেন। আমার মেয়ের হত্যাকারীদের তিনি বাচিয়ে দিতে পারেন। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস বিবাদী পক্ষের কাছ থেকে বড় অঙ্কের সুবিধা পেয়ে তিনি আমার মেয়েকে যারা হত্যা করেছে তাদের বাঁচিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন। তার মতে, আমার মেয়ে মারার সাথে জড়িত ছিলো সাতজন। তিনি তিনজনকে বাচিয়ে দিতে চান কোন স্বর্থে?



