বাংলাদেশের রেলওয়ে বৈদ্যুতিক বিভাগের দুর্নীতির অভিযোগ

ভূমিকা:
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় বৈদ্যুতিক বিভাগে ভয়াবহ দুর্নীতি, অনিয়ম, এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) কিশোর চন্দ্র দেব বর্মা এবং লাইনম্যান সুফিয়ানুর রহমান, তারা পদোন্নতি, বদলি, এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে ‘অপরাধ বিচিত্রা’র অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এই সিন্ডিকেটের পেছনে সিনিয়র সহকারী বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী পাহাড়তলী শেখ ফরিদের ইন্ধন রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সুফিয়ান-কিশোর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও অবৈধ অর্থ উপার্জন:
লাইনম্যান সুফিয়ানুর রহমান, যার বিরুদ্ধে শত অভিযোগ রয়েছে, তিনি পদোন্নতি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার এই দৌড়ঝাঁপের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছেন প্রকৌশলী শেখ ফরিদ। সুফিয়ান ও কিশোরের ‘মানিক জোড় সিন্ডিকেট’-এর দাপটে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুফিয়ানুর রহমান বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ উত্তোলন করেন:
- আখাউড়া-গঙ্গাসাগর: আখাউড়া-গঙ্গাসাগরের একটি অটো রিকশার গ্যারেজ থেকে প্রতি মাসে সুফিয়ান ২০,০০০ টাকা গ্রহণ করেন।
- কুমিল্লা: কুমিল্লার সুইপার কলোনি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলোনি, পানির পাম্পের পাশে একটি বস্তি, স্টেশনের বাইরের কিছু দোকান, পাবলিক টয়লেটসহ বেশকিছু লাইসেন্সধারী দোকানে মিটার বাইপাস করে প্রতি মাসে আনুমানিক ৭০,০০০ টাকা উত্তোলন করা হয়। এই অর্থ সুফিয়ান ও ২০২৩ ব্যাচের খালাসী তুষার সংগ্রহ করেন। অভিযোগ রয়েছে, এই ৭০,০০০ টাকার মধ্যে সুফিয়ান পান ২৫,০০০ টাকা, তুষার ১৫,০০০ টাকা এবং সিন্ডিকেটের ‘মনি মুকুট’ কিশোর বাবু পান ৫০,০০০ টাকা।
- লাকসাম: লাকসাম স্টেশনে কিছু দোকান মিটারবিহীন অবস্থায় চলছে। জিআরপি পুলিশ কলোনিতে ২টি বাসা ছাড়া বাকি সব বাসা মিটারবিহীন। প্রতিটি বাসা থেকে মাসে ১২০০ টাকা করে নেওয়া হয়। ট্রাফিক কলোনি, মালী কলোনি এবং লোকো কলোনিতেও বেশকিছু বাসায় মিটার নেই এবং কিছু বাসার বিদ্যুৎ লাইন বাইপাস করা হয়েছে। লাকসামে এই অর্থ লাইনম্যান সুফিয়ান এবং ২০১৫ ব্যাচের এ.ডব্লিউ.এম গ্রেড-৩ সোলায়মান মিলে মাসিক উত্তোলন করেন, যার আনুমানিক পরিমাণ ৩০,০০০ টাকা।
- নোয়াখালী, চৌমুহনী, মাইজদী, বজরা: এসব স্টেশন থেকে অবসরপ্রাপ্ত লাইনম্যান আবুল হোসেন খান টাকা উত্তোলন করেন, যার কোনো চুক্তিভিত্তিক আদেশ নেই। তিনি ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ লাকসাম কিশোর চন্দ্র দেব বর্মার মৌখিক আদেশে কাজ করছেন। তার সহযোগী হলেন এ.ডব্লিউ.এম গ্রেড-৩ আজিজুর রহমান। নোয়াখালী স্টেশন থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৭৫,০০০ টাকা ওঠে। এর মধ্যে আবুল হোসেন খান ২০,০০০ টাকা, সুফিয়ান ১৫,০০০ টাকা এবং বাকিটা ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ লাকসাম কিশোর চন্দ্র দেব বর্মা পান।
- ফেনী-মুহুরীগঞ্জ স্টেশন: ফাজিলপুর স্টেশনে সুফিয়ান এবং ফেনী স্টেশনের দায়িত্বে থাকা এফ.এ.পি গ্রেড-৩ আশিকুর রহমান (যিনি রেলওয়ের সাবেক এ.ডি.জি আর.এস ফারুক আহমেদের আপন ভাগিনা) টাকা উত্তোলন করেন। ফেনী-মুহুরীগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত ৪২,০০০ টাকা ওঠে, যার মধ্যে সুফিয়ান ও আশিক ২৫,০০০ টাকা এবং কিশোর বাবু ১৭,০০০ টাকা পান।
অবৈধ সামগ্রী বিক্রির অভিযোগ:
জানা গেছে, স্টোর ভেঙে রাতারাতি লাকসাম বৈদ্যুতিক বিভাগের অতি মূল্যবান বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও তামার তার বিক্রি করতে গিয়ে জনতার কাছে আটক হন কিশোর-সুফিয়ান সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান লাইনম্যান সুফিয়ান।

অন্যান্য অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার:
- ফেনী আল আমিন ফাস্ট ফুড: ফেনীর আল আমিন ফাস্ট ফুডের নামে কোনো বিদ্যুৎ বিল করা হয় না এবং বিদ্যুৎ মিটার অচল। এছাড়া ফেনীর ২টি পরিত্যক্ত কোয়ার্টার ও ৩টি কোয়ার্টারে, স্টেশনের ক্যান্টিন এবং বেশকিছু মিটার বাইপাস করা আছে। স্টেশনের বাইরে ৩টি দোকানেও অবৈধ লাইন রয়েছে।
- কিশোর চন্দ্র দেব বর্মার সরকারি বাসার অপব্যবহার: চট্টগ্রামে কিশোর বাবুর সরকারি বাসার নম্বর এম/১-এ সিআরবি। জিএম বাংলোর পিছনে কিশোর চন্দ্র দেব বর্মার নামে সরকারি বাংলো বরাদ্দ থাকলেও তিনি নিজে সেখানে থাকেন না। পুরো বাসা ভাড়া দিয়ে তিনি কুমিল্লায় পরিবার নিয়ে প্রাইভেট বাসায় থাকেন। তার ভাড়াটিয়ার নাম মোঃ খোকন, যিনি পাহাড়তলী রেলওয়ে কারখানায় টেন্ডল পদে কর্মরত এবং লাকসামের বাসিন্দা। খোকন প্রতি মাসে কিশোর বাবুকে ৪২,০০০ টাকা ভাড়া দেন।
- শেখ ফরিদের প্রভাব: অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সুফিয়ান সিন্ডিকেটের মাসোহারার একটি অংশ সিনিয়র সহকারী বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী পাহাড়তলী শেখ ফরিদসহ চিফ ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত দেওয়া হয়। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে বৈদ্যুতিক বিভাগ শেখ ফরিদের ইশারায় চলে। বিদ্যুৎ বিভাগের পুরো ডিপ্লোমা অ্যাসোসিয়েশন, অর্থাৎ কর্মরত ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ সবাই শেখ ফরিদের ইশারায় বদলি, পদোন্নতি ও পোস্টিং পান। কিছুদিন পূর্বে তিনিও ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী ছিলেন এবং পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে সিনিয়র সহকারী বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী হয়েছেন।
অভিযোগ দায়েরের চেষ্টা এবং ধামাচাপা দেওয়ার ঘটনা:
জয় জয় ভ্যারাইটিজ স্টোর, কুমিল্লার স্বত্বাধিকারী সঞ্জু (আসল নাম তাপস) সুফিয়ানের নামে লিখিত অভিযোগ ও কিছু লেনদেনের কল রেকর্ডসহ বিভাগীয় বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী চট্টগ্রাম আরিফুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে তথ্যগুলো দিতে গিয়েও সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে তা দিতে পারেননি। ডি.ই.ই-এর প্রধান সহকারী জনাব কফিল উদ্দিন সঞ্জুকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখিয়ে কল রেকর্ড ও অভিযোগ নিয়ে অফিস থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে কফিল উদ্দিন সুফিয়ানকে ফোন করে ভিডিও ও কল রেকর্ডকে জিম্মি করে সুফিয়ানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সমস্ত ভিডিও ও কল রেকর্ড ‘ভ্যানিশ’ করে দেন।
পদোন্নতিতে দুর্নীতির অভিযোগ:
বৈদ্যুতিক বিভাগের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে মোট ১৭ ক্যাটাগরিতে সম্প্রতি পদোন্নতি হতে যাচ্ছে। সুফিয়ান লাইনম্যান গ্রেড-২ থেকে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেতে এবং লাকসাম গ্রেড-১ পদোন্নতি পোস্টে বহাল থাকার জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, সিনিয়র সহকারী বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী পাহাড়তলী শেখ সাহেবকে ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ লাকসাম কিশোর চন্দ্র দেব বর্মার মাধ্যমে ‘ভালো অঙ্কের টাকা’ দেওয়া হয়েছে।
অভিযুক্তদের অস্বীকার:
- লাইনম্যান সুফিয়ানুর রহমান: তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “আমি এক টাকাও অবৈধ কারো কাছ থেকে নেই না। আমি ভালো কাজ করি তাই আমার পিছনে শত্রু লেগেছে।”
- ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ লাকসাম কিশোর চন্দ্র দেব বর্মা: ‘অপরাধ বিচিত্রা’র প্রতিনিধিকে তার অফিসে দাওয়াত দিয়ে বলেছেন, “আপনার কাছে যে তথ্য দিয়েছে সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি কোনো সিন্ডিকেট পরিচালনা করি না। আর কাউকে অতিরিক্ত সুবিধা দেই না। লেনদেনর বিষয়টি মিথ্যা।”
- সিনিয়র সহকারী বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী পাহাড়তলী শেখ ফরিদ: ‘অপরাধ বিচিত্রা’কে বলেন, “লাকসাম আমার অধীনে না। এদের সাথে আমার কোন কাজের সম্পর্ক নেই। তারা আমাকে রিপোর্ট করে না। আর পদোন্নতির পিছনে আমার কোন হাত নেই। টাকা নেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
উপসংহার:
বাংলাদেশ রেলওয়ের বৈদ্যুতিক বিভাগে উত্থাপিত এই গুরুতর অভিযোগগুলো প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অবৈধ অর্থ উপার্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং পদোন্নতিতে দুর্নীতির অভিযোগগুলো জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরি, যাতে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এবং রেলওয়ের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত হয়।



