বান মারা বা কালো যাদু: ইসলাম কী বলে ও কীভাবে সুরক্ষা পাবেন?

ইসলামে যাদু বা সিহরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়নি। তবে এটি একটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও কবিরা গুনাহের কাজ, যা মহান আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা না করার শামিল। লোকমুখে যা ‘বান মারা’ নামে পরিচিত, তা মূলত কালো যাদুরই একটি প্রকার। এ ধরনের কাজে শয়তানের সাহায্য নেওয়া হয় এবং এর উদ্দেশ্য থাকে অন্যের ক্ষতিসাধন করা। আসুন, ইসলাম কী বলে এবং এর থেকে বাঁচার উপায় কী, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
‘বান মারা’ বা কালো যাদু কী?
‘বান মারা’ বলতে সাধারণত এমন এক ধরনের কালো যাদুকে বোঝায়, যেখানে কোনো ব্যক্তির পোশাক, চুল, নখ বা ব্যবহৃত জিনিসপত্র ব্যবহার করে পুতুল বা অন্য কোনো বস্তুতে যাদু করা হয় এবং তা কবরস্থানে বা কোনো নির্জন স্থানে দাফন করা হয়। এর উদ্দেশ্য থাকে যার নামে যাদু করা হয়েছে, সেই জীবিত মানুষটিকে ধীরে ধীরে অসুস্থ করা বা জীবন কেড়ে নেওয়া – নাউজুবিল্লাহ।
ইসলামে এ ধরনের কাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যারা অন্যের ক্ষতির জন্য এমন কাজ করে, তারা ঈমান নিয়ে মরতে পারবে না।” (এটি একটি প্রসিদ্ধ অর্থ, তবে নির্দিষ্ট হাদীসের রেফারেন্স যাচাই করা উচিত)। কুরআন ও হাদীসের আলোকে এটি সুস্পষ্ট যে, যাদু করা এবং যাদু দ্বারা ক্ষতিসাধন করা মহাপাপ।
আপনি কি যাদুগ্রস্ত? কিছু সাধারণ লক্ষণ:
যাদু বা সিহরের প্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিভিন্ন অস্বাভাবিকতার সম্মুখীন হতে পারেন। তবে মনে রাখা জরুরি, এই লক্ষণগুলো সাধারণ রোগ বা মানসিক সমস্যার কারণেও হতে পারে। তাই প্রথমে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া এবং চিকিৎসা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। যদি চিকিৎসা সত্ত্বেও সমস্যা না কাটে, তবে আধ্যাত্মিক সমাধানের দিকে লক্ষ্য করা যেতে পারে।
যাদুগ্রস্ততার কিছু সম্ভাব্য লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. চোখের অস্বাভাবিকতা বা দৃষ্টিতে অস্বস্তি অনুভব করা।
২. কোনো কারণ ছাড়াই শরীর অস্বাভাবিক গরম থাকা।
৩. পিঠে ব্যথা, বিশেষত মেরুদণ্ডের নিচের দিকে তীব্র ব্যথা।
৪. (মহিলাদের ক্ষেত্রে) মাসিকের অস্বাভাবিকতা বা অনিয়মিত মাসিক; (পুরুষদের ক্ষেত্রে) প্রস্রাবে বারবার ইনফেকশনের সমস্যা।
৫. প্রায়শই পেটে ব্যথা অনুভব করা।
৬. দীর্ঘদিন চিকিৎসা গ্রহণ করার পরও কোনো রোগের উন্নতি না হওয়া।
৭. তীব্র মাথাব্যথা, যা ঔষধ সেবনের পরও কমে না।
৮. হঠাৎ করে কারো প্রতি তীব্র ঘৃণা বা তীব্র ভালোলাগা অনুভব হওয়া, যা স্বাভাবিক নয়।
৯. পরিবার, নিজের বাসা বা সমাজের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা অনুভব করা।
১০. বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত খুব অস্বস্তি বা মেজাজ খারাপ থাকা।
১১. কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করা।
১২. শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে অতিরিক্ত ব্যথা অনুভব করা।
১৩. ঠিকমতো ঘুমাতে না পারা; ঘুমালেও ভয়ংকর বা ভীতিকর স্বপ্ন দেখা।
১৪. স্বপ্নে কোনো গাড়ি বা হিংস্র প্রাণীকে (যেমন: কুকুর, বিড়াল, গরু, মহিষ, বাঘ, সিংহ, সাপ) আক্রমণ করতে বা ধাওয়া করতে দেখা।
১৫. স্বপ্নে কোনো ফাঁকা বাড়ি, মরুভূমি বা কবরস্থানে হাঁটাচলা করতে দেখা।
১৬. স্বপ্নে ঘনঘন বিভিন্ন জায়গায় পানি (যেমন: সাগর, নদী, পুকুর ইত্যাদি) দেখা।
১৭. স্বপ্নে ঘনঘন কোথাও আগুন জ্বলতে বা কিছু পোড়াতে দেখা।
১৮. স্বপ্নে নিজেকে উড়তে দেখা বা কোনো পাখি অথবা বড় বড় গাছ দেখা।
যদি এই লক্ষণগুলোর অনেকগুলি আপনার সাথে মিলে যায় এবং ডাক্তারি চিকিৎসায় কোনো সুরাহা না হয়, তবে আপনি যাদুগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা যেতে পারে।
যাদু ও শয়তানের চক্রান্ত থেকে বাঁচার ইসলামিক উপায়:
ইসলামে যাদু, বান বা জ্বিনের কুপ্রভাব থেকে বাঁচার জন্য শক্তিশালী আমল ও দোয়া রয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও যখন যাদু করা হয়েছিল, তখন আল্লাহ তায়ালা সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস – এই তিনটি সূরা নাজিল করেন। এই সূরাগুলো পাঠ করে নিজের ওপর দম করা বা ফুঁ দেওয়া যাদু ও সকল অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
আমলের পদ্ধতি:
প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় এবং ঘুমানোর পূর্বে দুই হাত এক করে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, এবং সূরা নাস – এই তিনটি সূরা প্রতিবার একটি করে পূর্ণরূপে তিনবার পাঠ করবেন। এরপর দুই হাতে ফু দিয়ে পুরো শরীর যতদূর সম্ভব মুছে দেবেন, বিশেষ করে মুখ, মাথা এবং শরীরের সামনের অংশ। ইনশাআল্লাহ, এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক আপনাকে সমস্ত প্রকার যাদু, বান, জ্বীনের দৃষ্টি এবং সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন।
সর্বোপরি, সর্বদা মহান আল্লাহ তায়ালার উপর পূর্ণ ভরসা রাখুন এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চান। তিনিই একমাত্র সত্তা, যিনি সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারেন। নিয়মিত সালাত আদায় করুন, কুরআন তিলাওয়াত করুন এবং নেক আমল দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে শয়তানের সকল প্রকার চক্রান্ত থেকে রক্ষা করুন, আমিন।



