যাকাত আদায় না করলে পরকালের ভয়াবহ পরিণতি: মেশকাত শরীফের আলোকে

ইসলামে যাকাত একটি ফরয ইবাদত এবং আর্থিক স্বচ্ছতার অন্যতম স্তম্ভ। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের সম্পদের ওপর নির্ধারিত হারে যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, যা গরিব ও অভাবীদের হক। যারা তাদের সম্পদের যাকাত সঠিকভাবে আদায় করে না, তাদের জন্য পরকালে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। মেশকাত শরীফের এক দীর্ঘ হাদীসে এই ভয়াবহ পরিণতির বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন:
১. সোনা ও রুপার যাকাত:
“যে সোনা ও রুপার অধিকারী ব্যক্তি তা থেকে যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত (তাকতি) তৈরি করা হবে। সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে এবং তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখনই সেগুলো ঠাণ্ডা হয়ে আসবে, পুনরায় গরম করা হবে – সেই দিনে, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। যতক্ষণ না বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি করা হয়, অতঃপর সে তার পথ ধরবে – হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।” [মুসলিম – ৬৮২২]
২. উটের যাকাত:
“জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! উট সম্পর্কে কী হবে?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘কোনো উটের অধিকারী যদি তার হক আদায় না করে, আর হকগুলোর মধ্যে (তাদের পানি পানের দিনে) দুধ দোহন করা একটি হক – যখন কিয়ামতের দিন আসবে, নিশ্চয় তাকে এক সুদূর ময়দানে উপুড় করে ফেলা হবে। আর তার সেই সকল উট, যার একটি বাচ্চাও সেদিন হারাবে না বরং সকলকে পূর্ণভাবে পাবে, তাকে তার ক্ষুর দিয়ে মাড়াতে থাকবে এবং মুখ দিয়ে কামড়াতে থাকবে। এভাবে এই উটগুলোর শেষ দল অতিক্রম করবে এবং পুনরায় প্রথম দল এসে পৌঁছবে। এরূপ করা হবে সেই দিনে, যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান, যতক্ষণ না আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ ধরবে – হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।”
৩. গরু ও ছাগলের যাকাত:
“তারপর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! গরু-ছাগল সম্পর্কে কী হবে?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘প্রত্যেক গরু ও ছাগলের অধিকারী, যে এর পক্ষ থেকে হক আদায় করবে না, যখন কিয়ামতের দিন আসবে, নিশ্চয় তাকে এক সুদূর মাঠে উপুড় করে ফেলা হবে। আর তার সেই সকল গরু-ছাগল তাকে শিং নিয়ে মারতে থাকবে এবং ক্ষুর দিয়ে মাড়াতে থাকবে। অথচ সেদিন তার কোনো একটি গরু বা ছাগলই শিং বাঁকা, শিংহীন বা শিং ভাঙ্গা হবে না এবং একটি মাত্র গরু-ছাগলকেও সে হারাবে না। যখনই প্রথম দল অতিক্রম করবে, শেষ দল এসে পৌঁছবে। সেই দিনে, যে দিনের পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান, যতক্ষণ না আল্লাহর বান্দাদের বিচার মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ ধরবে – হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।”
৪. ঘোড়ার প্রকারভেদ ও তার বিধান:
“এরপর জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! ঘোড়া সম্পর্কে কী হবে?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘ঘোড়া তিন প্রকারের। কারও জন্য তা গুনাহের কারণ, কারও জন্য আবরণস্বরূপ, আর কারও জন্য সওয়াবের বিষয়।'”
- (ক) গুনাহের কারণ: “যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে গুনাহের কারণ, তা হলো সেই ব্যক্তির ঘোড়া, যে তা পালন করেছে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে, গর্ব করার জন্য এবং মুসলমানদের প্রতি শত্রুতার বশে। এই ঘোড়া হলো তার গুনাহের কারণ।”
- (খ) আবরণস্বরূপ: “যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে আবরণস্বরূপ, তা হলো সেই ব্যক্তির ঘোড়া, যে তা পালন করেছে আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদের উদ্দেশ্যে), অতঃপর এর সম্পর্কে এবং এর পিঠ সম্পর্কে আল্লাহর হক ভুলেনি। এই ঘোড়া হলো তার ইজ্জত-সম্মানের জন্য আবরণস্বরূপ।”
- (গ) সওয়াবের কারণ: “যে ঘোড়া মালিকের পক্ষে সওয়াবের কারণ, তা হলো সেই ব্যক্তির ঘোড়া, যে তা পালন করেছে কোনো চারণভূমিতে বা ঘাসের বাগানে শুধু আল্লাহর রাস্তায় মুসলমানদের দেশ রক্ষার জন্য। তখন তার সেই ঘোড়া চারণভূমি অথবা বাগানের যা কিছু খাবে, তার পরিমাণ তার জন্য নেকী লেখা হবে এবং গোবর ও প্রস্রাবের পরিমাণও নেকী লেখা হবে। আর যদি সেই ঘোড়া রশি ছিঁড়ে একটি কিংবা দু’টি মাঠও বিচরণ করে, তাহলে নিশ্চয় তার পদচিহ্ন ও গোবরসমূহ পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে। এছাড়া ঘোড়ার মালিক যদি ঘোড়াকে কোনো নদীর কিনারায় নিয়ে যায়, আর নদী থেকে পানি পান করে, অথচ মালিকের ইচ্ছা ছিল না পানি পান করানোর, তথাপিও লেখা হবে ঘোড়ার পানি পান পরিমাণ তার জন্য নেকী।”
৫. গাধার যাকাত:
“অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! গাধা সম্পর্কে কী হবে?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘গাধার বিষয়ে আমার প্রতি এই স্বতন্ত্র ও ব্যাপক অর্থবোধক আয়াতটি ছাড়া (নির্দিষ্ট কোনো বিধান) নাযিল হয়নি: ‘যে ব্যক্তি এক অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তার ফল পাবে, আর যে এক অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তার মন্দ ফল ভোগ করবে।’ অর্থাৎ, গাধার যাকাত দিলে তারও সওয়াব পাওয়া যাবে।” [মুসলিম]
সম্পদ সঞ্চয়কারীদের জন্য বিশেষ সতর্কতা:
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীসে নবী করীম (সা.) বলেছেন: “যাকে আল্লাহ পাক সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে যাকাত প্রদান করেনি, কিয়ামতের দিন তার সেই মালকে তার জন্য একটি মাথার টাক পড়া সাপ (বিষধর সাপ) স্বরূপ করা হবে। এর দুটি দাগ থাকবে (বিষের চিহ্ন) এবং তা তার গলার বেড়ি স্বরূপ করা হবে। উক্ত সাপ তার আপন মুখের দুই দিক দিয়ে তাকে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে: ‘আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত মাল’।” [বুখারী – ১১৪৫, মুসলিম – ৯১৮, আবু দাউদ – ১৪৮৮; মিশকাতুল মাসাবীহ – ১৬১৮, ৯১৮] (এই অংশটি মূল হাদীসের পূর্ণাঙ্গ রূপ, যা আপনার দেওয়া অসম্পূর্ণ অংশ থেকে অনুমান করে পূর্ণ করা হয়েছে।)
এই হাদীসগুলো সম্পদশালীদের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা। যাকাত কেবল একটি আর্থিক ইবাদত নয়, বরং এটি সম্পদের পবিত্রতা এবং পরকালীন মুক্তির চাবিকাঠি। আমাদের উচিত, আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের হক যথাযথভাবে আদায় করা এবং তাঁর ক্রোধ থেকে আশ্রয় চাওয়া।



