অপরাধএক্সক্লুসিভদুর্নীতিবাংলাদেশরাজনীতিরাজনীতিরাজশাহীসংগঠন

ছাত্রলীগ নেতা থেকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ ও ‘সাহসী সাংবাদিক’: সোহাগ হোসেন রুবেলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

প্রতিবেদক: আব্দুল কালাম

জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আবহে সুযোগসন্ধানী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। সোহাগ হোসেন ওরফে রুবেল হোসেন নামের এই ব্যক্তি একসময় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, জুলাই আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েও পরবর্তীকালে নিজেকে ‘আহত জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সরকারি গেজেটে নাম তুলেছেন এবং নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এমনকি, সাংবাদিক না হয়েও তিনি ‘সাহসী সাংবাদিক’ সম্মাননা পেয়েছেন বলে অভিযোগ।

সোহাগ হোসেনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ:

১। ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা: সোহাগ হোসেন, যিনি বরগুনার স্থায়ী বাসিন্দা এবং বর্তমানে ডেমরায় বসবাস করছেন, ৫ই আগস্ট, ২০২৪-এর আগে বঙ্গবন্ধু ল’ ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগ আইন জেলা শাখার কেন্দ্রীয় পদধারী নেতা ছিলেন। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

২। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হামলা: অভিযোগ অনুযায়ী, জুলাই ও আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তিনি তার বাহিনী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর সরাসরি হামলায় নেতৃত্ব দেন। ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলার ছবিতেও তাকে দেখা গেছে বলে দাবি করা হয়েছে।

৩। প্রতারণার মাধ্যমে ‘জুলাই যোদ্ধা’: যাত্রাবাড়ীতে জনতার ওপর হামলার সময় তিনি গণধোলাইয়ের শিকার হন এবং মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরবর্তীতে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই হাসপাতালের কাগজপত্র ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে তিনি সরকারি আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করান। তার আহত জুলাই গেজেট নম্বর ৩৬৩ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪। সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ: ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনি প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি অনুদান পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি সরকারি ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছেন এবং বরগুনার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকেও বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ।

৫। ‘সাহসী সাংবাদিক’ সম্মাননা লাভ: সবচেয়ে বিস্ময়কর অভিযোগ হলো, জীবনে কোনোদিন সাংবাদিকতা না করেও তিনি বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ‘সাহসী সাংবাদিক’ হিসেবে সম্মাননা ও অনুদান পেয়েছেন। সাংবাদিক সম্মাননা তালিকায় তার ক্রমিক নম্বর ৩২ এবং তিনি ‘সবুজ বাংলাদেশ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। অভিযোগকারীরা দাবি করছেন, সোহাগ হোসেন তার প্রকাশিত একটি সংবাদেরও প্রমাণ দিতে পারবেন না।

৬. পূর্বের কর্মকাণ্ড ও বর্তমান পরিচয়: অভিযোগ রয়েছে, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তিনি যাত্রাবাড়ীর ফলের আড়ত দখল করে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন। বর্তমানে তিনি নিজেকে ‘আহত জুলাই যোদ্ধা’ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অঙ্গসংগঠন তাঁতী দলের নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন তদবির ও বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি সমালোচিত হওয়ার পর তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে স্ট্যাটাস সরিয়ে নিজেকে তাঁতী দলের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন।

পটভূমি ও বাস্তবতা:

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলার ঘটনা ঘটেছিল, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।[1][2][3] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি ১২২ জন হামলাকারীকে শনাক্তও করে। অন্যদিকে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সম্মানিত করতে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করছে এবং তাদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। একইসাথে, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট জুলাই অভ্যুত্থানের সময় দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকদের ‘সাহসী সাংবাদিক সম্মাননা’ প্রদান করেছে।

তবে, সোহাগ হোসেন ওরফে রুবেল হোসেনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো, যেমন তার গেজেট নম্বর বা সাংবাদিক সম্মাননা তালিকার ক্রমিক নম্বরের সত্যতা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এই ধরনের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর, যেমন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে এবং তার প্রকৃত পরিচয় ও কর্মকাণ্ড উন্মোচনের দাবি জানাচ্ছেন নেটিজেনরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button