অপরাধঅব্যাবস্থাপনাআইন ও বিচারজাতীয়দেশবাংলাদেশবিবিধবিশ্লেষণমতামতরাষ্ট্রনীতিশিক্ষাসংগঠন

জুলাই বিপ্লবের পাহারাদারদের অপমান: রাষ্ট্রের প্রতারণা ও ড. ইউনূসের নির্বাচনমুখী যাত্রা

মতামত, অধ্যাপক এম এ বার্ণিক

ভূমিকা: এক বিস্মৃত অধ্যায়

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। বাংলার ইতিহাসে ছাত্র-জনতার রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে লেখা হলো এক অসামান্য গণ-অভ্যুত্থানের অধ্যায়। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটল, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র প্রায় ভেঙে পড়ল। সেই চরম শূন্যতায় যখন গোটা দেশ স্থবির, তখন এক আশ্চর্য শক্তি নিয়ে রাজপথ আগলে রেখেছিল ছাত্রসমাজ। দেশের পাহারাদার হয়ে উঠেছিল তারা।

আজ তাদের সেই অবদানকে ভুলিয়ে দেওয়ার এক গভীর চক্রান্ত চলছে। রাষ্ট্র ছাত্রদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে যিনি ছাত্রদের আমন্ত্রণে দায়িত্বে এসেছেন, তিনি তাদের মূল দাবিগুলো না শুনে রাজনৈতিক চুক্তির পথে হাঁটছেন, যা বিপ্লবের ભાવনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।

যখন রাষ্ট্র ছিল না, ছাত্ররা ছিল

অভ্যুত্থানের পর রাজপথে নেমে এসেছিল এক মহাশূন্যতা। পুলিশ, প্রশাসন বা কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব—কেউই ছিল না দৃশ্যপটে। সেই সংকটকালে ছাত্ররাই কাঁধে তুলে নিয়েছিল দেশের দায়িত্ব:

  • তারা ঝাড়ু হাতে রাজপথ পরিষ্কার করেছে।
  • নিজেদের উদ্যোগে ট্রাফিক ব্যবস্থা সচল রেখেছে।
  • আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সংগঠিত হয়েছে।
  • এমনকি, তারাই ড. মুহম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

এই দুঃসময়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতাকে রাজপথে দেখা যায়নি।

ক্ষমতা নয়, নৈতিকতার শক্তিতে বলীয়ান ছাত্রসমাজ

এই বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন হাসনাত আবদুল্লাহ, নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম এবং তাসনিম জারার মতো তরুণেরা, যাদের ওপর ছিল জনগণের আস্থা। তারা চাইলে সেই মুহূর্তে একটি বিপ্লবী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ না হয়ে তারা বলেছিলেন, “সংবিধান ও ন্যায়ের ভিত্তি ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা নয়।” এই আপসহীন নৈতিক অবস্থানই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। অথচ আজ রাষ্ট্র যেন সেই শক্তিকেই তাদের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে।

অবমাননা ও পুরনো শক্তির পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র

জাতি যাদের কাঁধে ভর করে একটি বিপ্লব সফল করল, আজ তাদেরই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহতদের চিকিৎসা, শহীদদের মর্যাদা—কোনো কিছুই তারা পায়নি। উল্টো পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বাসন করার এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। এই চক্রান্ত একদিকে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে, অন্যদিকে ইতিহাসের সঙ্গেও করছে প্রতারণা।

ড. ইউনূসের ইউ-টার্ন: সংস্কারের বদলে নির্বাচন কেন?

যখন রাষ্ট্রের ভার ছাত্রদের কাঁধে, তখন তারা ড. মুহম্মদ ইউনূসকে “গণসংলাপভিত্তিক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান” হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাদের প্রস্তাব ছিল সুস্পষ্ট:

  • ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর করা।
  • সংবিধান পুনর্লিখন বা সংস্কারের জন্য গণভোটের আয়োজন করা।
  • জনগণের মতামত গ্রহণ করে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা।
  • এবং এরপর একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিকল্পনা করা।

সে সময় ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন:

“জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত না হলে, আমরা নতুন রাষ্ট্রের পথে এক পা-ও এগোতে পারি না। নির্বাচন মানে পুরনো শকুনদের ফেরত আনা।”

কিন্তু ড. ইউনূস সেই সব দাবিকে পাশ কাটিয়ে, কোনো ধরনের সংলাপ ছাড়াই আকস্মিকভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। প্রশ্ন হলো, কার স্বার্থে এই তাড়াহুড়ো?

পরিবারতন্ত্রের ছায়া: কার পরামর্শ শুনছেন ড. ইউনূস?

ড. ইউনূসের এই অবস্থান অনেককেই বিস্মিত করেছে। কারণ, যারা তাঁকে দায়িত্বে বসিয়েছেন, তারা সংস্কার ও গণভোটের দাবিদার। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে পুরনো রাজনৈতিক শক্তির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে তারেক রহমানের গোপন সমর্থনের গুঞ্জনও উঠেছে। সমালোচকরা বলছেন, “নির্বাচনমুখী রোডম্যাপ দিয়ে ড. ইউনূস আসলে পরিবারতন্ত্রকেই পুনর্বহাল করতে চাইছেন।” বিএনপি বা আওয়ামী লীগ—উভয় পরিবারতান্ত্রিক বলয়ের বাইরে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার পরিবর্তে, তিনি কি ক্ষমতার পুরনো কাঠামোকেই গ্রহণ করে নিচ্ছেন?

রাষ্ট্রীয় প্রতারণা এবং ভাঙা অঙ্গীকার

অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল: “ছাত্ররা এই জাতির গর্ব। রাষ্ট্র তাদের পাশে থাকবে।” কিন্তু বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত:

  • শহিদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও তৈরি হয়নি।
  • আহত হাজারো ছাত্র-জনতা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।
  • ছাত্রনেতাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোন্দলে তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এটি রাষ্ট্রীয় প্রতারণার এক নির্লজ্জ উদাহরণ।

ইতিহাস ও উত্তরাধিকারের প্রশ্ন

এই বিপ্লবের উত্তরাধিকার কারা বহন করবে? যারা রক্ত দিয়ে রাজপথ পাহারা দিয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে তারা? নাকি যারা ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে পর্দার আড়ালে দরকষাকষি করে মসনদে ফেরার অপেক্ষায় ছিল? ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না।

জুলাই বিপ্লবের শহিদদের নাম একদিন পাঠ্যবইয়ে লেখা হবে। হাসনাত আবদুল্লাহ, নাহিদ ইসলাম, তাসনিম জারা, সারজিস আলম—এই নামগুলোই হয়তো ভবিষ্যতের নেতৃত্বের আদর্শ হয়ে থাকবে, যদি না রাষ্ট্র এই ইতিহাস মুছে ফেলার চক্রান্তে সফল হয়।

প্রস্তাবনা

জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের দাবি સ્પષ્ટ:

১. কোনো নির্বাচনের আগে অবশ্যই ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর করতে হবে।
২. গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনার কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু করতে হবে।
৩. বিপ্লবী ছাত্রনেতাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পরিবারতন্ত্রমুক্ত একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গঠনের রূপরেখা ঘোষণা করতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button