যে ঘটনায় রাসূল (সাঃ) হেঁচকি দিয়ে কেঁদেছিলেন: এক পিতার আর্তি ও সন্তানের অভিযোগ

ইসলামিক ডেস্ক:
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও ভালোবাসার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। তাদের সামান্য অবহেলা বা অসম্মান আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দরবারে, যা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আসুন, জেনে নিই সেই শিক্ষণীয় ঘটনাটি।
ছেলের অভিযোগ ও পিতার আগমন
একবার এক সাহাবী রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে অভিযোগ করে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা আমার অনুমতি ছাড়াই আমার সম্পদ ব্যয় করে ফেলেন।”
রাসূল (সাঃ) অভিযোগ শুনে বললেন, “তোমার বাবাকে ডেকে আনো।”
যখন বৃদ্ধ বাবাকে ডেকে পাঠানো হলো এবং তিনি জানতে পারলেন যে, তার সন্তানের অভিযোগের কারণে তাকে ডাকা হয়েছে, তখন তিনি অত্যন্ত কষ্ট পেলেন। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি মনে মনে কয়েকটি কবিতার লাইন আবৃত্তি করতে করতে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারের দিকে অগ্রসর হলেন।
ঐশী হস্তক্ষেপ ও কবিতার রহস্য
বৃদ্ধ পিতা যখন দরজার কাছে পৌঁছালেন, ঠিক সেই মুহূর্তে হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূল (সাঃ)-এর কাছে অবতীর্ণ হলেন। তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন, আপনি এই ব্যক্তির সমস্যার কথা পরে শুনবেন। প্রথমে তার কাছ থেকে সেই কবিতাটি শুনুন, যা তিনি ছেলের দুঃখে ব্যথিত হয়ে মনে মনে বলেছেন। তিনি এটি সশব্দে বলেননি, কিন্তু আরশের ওপর থেকে আল্লাহ তা শুনেছেন।”
রাসূল (সাঃ) তখন বৃদ্ধ লোকটিকে বললেন, “আপনার সমস্যার কথা পরে শুনছি, আগে আপনি সেই কবিতাটি শোনান, যা একটু আগে আপনি মনে মনে পড়ছিলেন।”
এই কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি বিস্মিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল। হে আল্লাহর রাসূল! আমি দুঃখে কয়েকটি লাইন মনে মনে বলেছিলাম, জোরে বলিনি। তবুও আপনার রব তা আরশের ওপর থেকে শুনেছেন। সত্যিই আপনি সত্য এবং আপনার রবও সত্য।”
রাসূল (সাঃ) বললেন, “আপনি কী বলেছিলেন?”
পিতার মর্মস্পর্শী আর্তি
তখন সেই পিতা তার হৃদয়ের সবটুকু কষ্ট ঢেলে দিয়ে বললেন:
“হে আমার পুত্র! যেদিন তুই জন্ম নিয়েছিলি, সেদিন থেকে আমি নিজের জন্য বাঁচতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল কেবল তোর জন্য।”
“তোকে শীতল ছায়ায় রাখার জন্য আমি নিজে তপ্ত রোদে পুড়েছি। তোকে কনকনে শীত থেকে বাঁচাতে আমি নিজে বরফের মতো ঠান্ডা সহ্য করেছি। তোর মুখে একটু হাসি দেখার জন্য আমি রাতের পর রাত ছটফট করেছি।”
“আমার যৌবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি তোর জন্য খেটেছি, শুধু তোকে বড় করে তোলার জন্য।”
“আমি ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হতে লাগলাম, আর তুই যুবক হতে শুরু করলি। আমার কোমর দুর্বলতায় বেঁকে যেতে লাগল, আর তোর কোমর শক্ত হলো। আমার পায়ে জোর কমে গেল, তোর পায়ে শক্তি বাড়ল। আমার হাত কাঁপতে শুরু করল, তোর হাত মজবুত হলো। আমি বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়লাম, আর তুই অহংকারী হয়ে উঠলি।”
“আমি ভেবেছিলাম, আমার এই পড়ন্ত বয়সে তুই আমার আশ্রয় হবি। যেমন করে আমি তোর জন্য আল্লাহর কাছে ছটফট করতাম, দোয়া করতাম।”
“কিন্তু যখন তোর মধ্যে যৌবনের শক্তি টগবগ করছিল, আর বার্ধক্য আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল, তখন তুই আমার দিকে এমনভাবে তাকাতে শুরু করলি, যেন তুই আমার মালিক আর আমি তোর অধীনস্থ চাকর।”
“তোর সেই চাহনি দেখে আমি আমার ত্রিশ বছরের সব ত্যাগ ভুলে গিয়ে বলতে বাধ্য হলাম, ‘হ্যাঁ, আমি বাবা নই, আমি চাকরই’।”
“হে নবী (সাঃ)! আপনিই বলুন, যদি সে আমাকে সন্তান হিসেবে দেখত, তবে কি এভাবে তাকাতো?”
“এই ছেলে আমার নির্ঘুম রাতগুলোকে ভুলে গেছে, আমার শীত-গরমের সাথে লড়াই করাকে ভুলে গেছে, আমার কঠোর পরিশ্রমকে ভুলে গেছে, আমার সকল সুখ-দুঃখকে দাফন করার কাহিনী ভুলে গেছে।”
“আজ সে আমার সাথে এমনভাবে কথা বলে, যেন সে আমার মনিব। ঠিক আছে, আমি না হয় চাকরই, তুই আমার মালিক। কিন্তু আমি তো তোর প্রতিবেশী। মানুষ তো প্রতিবেশীকেও জিজ্ঞেস করে, সে কেমন আছে, তার কোনো প্রয়োজন আছে কিনা। তুই তো আমাকে ততটুকুও জিজ্ঞেস করিস না।”
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অশ্রু ও চূড়ান্ত রায়
বৃদ্ধ পিতার এই কথাগুলো শুনতে শুনতে আল্লাহর নবী (সাঃ) কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তিনি হেঁচকি দিয়ে কাঁদছিলেন।
এরপর তিনি ওই ছেলের কাঁধ ধরে কঠোর স্বরে বললেন:
“আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। তুমি এবং তোমার সকল সম্পদ—সবই তোমার বাবার।”
এই ঘটনাটি আমাদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। পিতা-মাতার প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তা রাসূল (সাঃ) তার অশ্রু এবং এই রায়ের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার এবং তাদের সর্বোচ্চ সম্মান করার তাওফিক দান করুন। আমীন।



