স্বামীর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ: র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা আলেপ উদ্দিনের বিরুদ্ধে লোমহর্ষক অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ পুলিশের বরখাস্তকৃত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং র্যাবের সাবেক কোম্পানি কমান্ডার আলেপ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, গুম, নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এসব অভিযোগের মধ্যে একজন ভুক্তভোগীর স্বামীকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে তার স্ত্রীকে একাধিকবার ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে, যার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
নির্যাতনের শিকার এমনই এক ভুক্তভোগীর জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সেই ভয়ঙ্কর সময়ের করুণ চিত্র, যা যেকোনো মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ভুল পরিচয়ে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের সূচনা
ঘটনার সূত্রপাত ২০১৫ সালের ৩০ মে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থীকে তার বনশ্রীর বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে। মূলত অন্য এক ব্যক্তিকে খুঁজতে এসে তাকে না পেয়ে ভুলবশত এই তরুণকে আটক করা হয়।
ভুক্তভোগী ওই তরুণ বলেন, “ধরার পরপরই আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু হয়। যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারে যে আমি ভুল ব্যক্তি, ততক্ষণ টর্চার চলে। তাদের খুঁজছিলেন এমন কাউকেই আমি চিনতাম না। ভুল বুঝতে পারার পর তারা নির্যাতন বন্ধ করলেও আমাকে টানা আট দিন ঘুমাতে দেয়নি।”
তাকে বিভিন্ন মামলায় মোট ২৩-২৪ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং সেখানেও নির্যাতন চলে। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার সময় তাকে একটি সাজানো স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তাকে এবং আরও কয়েকজনকে ব্যাংক ডাকাতের পরিকল্পনাকারী হিসেবে দেখানো হয়। তবে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সত্য তুলে ধরেন। শেষ পর্যন্ত পাঁচটি মামলায় তাকে ২৩ মাস জেল খাটতে হয়।
দ্বিতীয় দফা হয়রানি ও স্ত্রীকে জিম্মি
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ব্যবসায় মনোযোগ দেন। কিন্তু ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবারও বিপদের মুখে পড়েন। তিনি বলেন, “আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার ফোন দিয়ে জানায়, কালো গ্লাসওয়ালা মাইক্রোবাসে কিছু লোক আমাকে খুঁজছে। আমি পালানোর সিদ্ধান্ত নিই, কিন্তু এর ফল হয় ভয়াবহ।”
র্যাব তাকে ধরতে না পেরে তার স্ত্রী ও শ্যালককে ধরে নিয়ে যায় এবং তিন দিন র্যাব-১১-এর হেফাজতে রাখে। তখন তাকে শর্ত দেওয়া হয়, তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “আমি শর্ত দিই যে, আগে আমার স্ত্রী ও শ্যালককে মুক্তি দিতে হবে। তাদের ছেড়ে দেওয়ার পর আমি আমার স্ত্রীকে নিয়েই র্যাবের কার্যালয়ে আত্মসমর্পণ করি। ভেবেছিলাম, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে হয়তো ছেড়ে দেবে। কিন্তু আমি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”
র্যাব হেফাজতে স্ত্রীর ওপর মানসিক নির্যাতন
ভুক্তভোগীর স্ত্রীকে তিন দিন এমন একটি সেলে আটকে রাখা হয়েছিল, যেখানে শৌচাগারের পাশের দেয়াল ছিল না এবং সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। সেই তিন দিন তাকে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি এবং ‘জঙ্গির বউ’ ও ‘জঙ্গি মদদদাতা’ বলে ক্রমাগত গালাগাল ও আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করা হয়।
অফিসার্স কোয়ার্টারে ভয়ঙ্কর সেই ঘটনা
স্বামীর গ্রেপ্তারের পর থেকেই আলেপ উদ্দিন ওই নারীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে এবং নানাভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলতে থাকে। স্বামীর জামিনের পর আলেপ উদ্দিন তাকে ও তার স্ত্রীকে তার অফিসে ডেকে পাঠায়। সেখানে ওই তরুণকে গেস্টরুমে পাঠিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে “ব্যক্তিগত কথা আছে” বলে আলেপ তাকে চেম্বারে আটকে রাখে।
ভুক্তভোগী তরুণ বলেন, “১৫-২০ মিনিট পর আমার স্ত্রী যখন গেস্টরুমে ফিরে আসে, আমি দেখি তার চেহারা বিধ্বস্ত, চোখ ছলছল করছে এবং সে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। মনে হলো, তাকে এমন কিছু বলা হয়েছে, যা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছে।”
এরপর স্ত্রীর ক্রমাগত মনমরা হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে একপর্যায়ে তিনি সব খুলে বলেন। স্বামীকে ক্রসফায়ার ও নতুন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আলেপ উদ্দিন তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছে।
প্রথমবার, আলেপ মামলার তদন্তের কথা বলে ওই নারীকে তাদের আফতাবনগরের বাসায় ডেকে আনে এবং শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে, তবে ব্যর্থ হয়। এরপর স্বামীর জামিনের পর তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয় আলেপ। সে ওই নারীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, “এখন সবকিছু আমার হাতে। চাইলে আমি তোমার স্বামীকে ছেড়ে দিতে পারি, আবার চাইলে ক্রসফায়ারে হত্যা করতে পারি।”
এই অসহনীয় চাপের মুখে ওই নারীকে তার অফিসে ডেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে র্যাব অফিসার্স কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তাকে প্রথমবার ধর্ষণ করা হয়।
ভুক্তভোগী তরুণ আরও বলেন, “এরপর রোজার মাসে, শবে কদরের দিন, আমি যখন মসজিদে এতেকাফে বসেছিলাম, তখন আলেপ আমার স্ত্রীকে আবার হুমকি দেয়। আমাকে মসজিদ থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে সে আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং সেই কোয়ার্টারেই দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করে।”
একটি সাজানো সংসারের করুণ পরিণতি
এই ভয়াবহ মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ওই নারীর জীবন চিরতরে বদলে দেয়। তিনি তীব্র ট্রমার শিকার হন এবং আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। ভুক্তভোগী স্বামী বলেন, “আমার স্ত্রী আর এই ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি। দিনের পর দিন শুধু কাঁদত। রাতে মোনাজাতে দুই হাত তুলে ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদত। বড় বড় মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়েছি, কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। হাসপাতালে যখন কথা বলতে পারত না, তখনও চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদত, যেন আমি তাকে ক্ষমা করে দিই।”
রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্য ও আলেপের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
এই অভিযোগের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, “আলেপ উদ্দিনের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো অত্যন্ত মারাত্মক। স্বামীকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণের তথ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে এসেছে। তিনি অসংখ্য মানুষকে গুম ও নিষ্ঠুরতম পন্থায় নির্যাতন করেছেন। ইলেকট্রিক শক দেওয়া, চোখ বেঁধে রাখা, উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো—সবই তিনি করেছেন।”
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, “সবচেয়ে মারাত্মক যে অপরাধ তিনি করেছেন, তা হলো গুম করে স্বামীকে হত্যার ভয় দেখিয়ে তার স্ত্রীকে রোজার মাসে রোজা ভাঙিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা। এর তথ্য-প্রমাণাদি আমরা পেয়েছি।”
আলেপ উদ্দিনের বিরুদ্ধে এমন অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে, যেখানে তুচ্ছ কারণে মানুষকে গুম করে বছরের পর বছর নির্যাতন করা হয়েছে এবং তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের শিকার এসব মানুষ আজও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।



