আইন ও বিচারআইন, ও বিচারজাতীয়বাংলাদেশরাজনীতিরাষ্ট্রনীতি

সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক:

গণমাধ্যমকর্মী ও সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা, অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং দায়িত্ব পালনকালে সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি রোধকল্পে “সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫” জারি করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করেন, যা অবিলম্বে কার্যকর বলে গণ্য হবে।

এই অধ্যাদেশটি সংবিধানের ৩২, ৩৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকারকে ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হয়েছে।

অধ্যাদেশের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকরা প্রায়শই সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হন। তাদের পর্যাপ্ত আইনগত সুরক্ষা প্রদান এবং একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাই এই অধ্যাদেশের প্রধান লক্ষ্য। সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকায় রাষ্ট্রপতি এই অধ্যাদেশ জারি করেন।


অধ্যাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিধানসমূহ

অধ্যাদেশটিকে মোট ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে, যেখানে সংজ্ঞা, অধিকার, অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি, শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

প্রথম অধ্যায়: প্রারম্ভিক

  • সংজ্ঞা: অধ্যাদেশে ‘অপরাধ’, ‘গণমাধ্যম’, ‘সাংবাদিক/সংবাদকর্মী’, এবং ‘সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে।
    • সাংবাদিক/সংবাদকর্মী: সার্বক্ষণিক, খণ্ডকালীন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সম্পাদক, রিপোর্টার, চিত্রগ্রাহক, কার্টুনিস্টসহ গণমাধ্যমে কর্মরত প্রায় সকল কর্মীকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
    • সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি: জীবন ও সম্পদ ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, অবৈধ আটক, গুম এবং অপহরণের মতো বিষয়গুলো এর আওতায় আসবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা

  • জীবন ও সম্পদ সুরক্ষার অধিকার: যেকোনো সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সরকার ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পণ করা হয়েছে।
  • তথ্যের উৎসের গোপনীয়তা: কোনো সাংবাদিককে তার তথ্যের উৎস প্রকাশে বাধ্য করা যাবে না।
  • স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন: সাংবাদিকদের ভয়ভীতি ও চাপমুক্ত পরিবেশে দায়িত্ব পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নিজ প্রতিষ্ঠানেও স্বাধীন ও অনুকূল পরিবেশে কাজ করার অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
  • সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের সুরক্ষা: সরল বিশ্বাসে জনস্বার্থে কোনো তথ্য বা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করা যাবে না, যদি না অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়।

তৃতীয় অধ্যায়: অভিযোগ দায়ের

  • অভিযোগ পদ্ধতি: সহিংসতার শিকার কোনো সাংবাদিক প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লিখিতভাবে, অনলাইনে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
  • তদন্ত: আদালত অভিযোগটি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়ে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেবেন, যা প্রয়োজনে আরও ৩০ দিন বাড়ানো যাবে।

চতুর্থ অধ্যায়: অপরাধ, শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ

  • শাস্তি: কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হুমকি বা হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য মাত্রাভেদে সর্বনিম্ন ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বনিম্ন ১ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
  • ক্ষতিপূরণ: আদালত আরোপিত অর্থদণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করতে পারবেন এবং দণ্ডিত ব্যক্তির কাছ থেকে তা আদায় করা হবে।

পঞ্চম অধ্যায়: বিচার ও তদন্ত

  • বিচার: এই অধ্যাদেশের অধীন অপরাধের বিচার প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অনুষ্ঠিত হবে।
  • জামিনযোগ্যতা: এই অধ্যাদেশের অধীন সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য হবে।
  • তদন্তকারী কর্মকর্তা: সহকারী পুলিশ সুপারের পদমর্যাদার নিচে নন, এমন পুলিশ কর্মকর্তা মামলার তদন্ত করবেন।
  • মিথ্যা অভিযোগের শাস্তি: কোনো সাংবাদিক যদি কাউকে ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগ করেন, তবে তার জন্য সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

ষষ্ঠ অধ্যায়: বিবিধ

  • কোম্পানি কর্তৃক অপরাধ: কোনো কোম্পানির মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হলে তার পরিচালক, ব্যবস্থাপক বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও অভিযুক্ত হবেন, যদি না তারা প্রমাণ করতে পারেন যে ঘটনাটি তাদের অজ্ঞাতসারে ঘটেছে বা তারা তা রোধে সচেষ্ট ছিলেন।
  • বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা: সরকার এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিধি প্রণয়ন করতে পারবে এবং এর একটি নির্ভরযোগ্য ইংরেজি পাঠও প্রকাশ করবে। বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button