ইসলামে কবর সংক্রান্ত বিধান ও নির্দেশনা

ইসলাম ধর্মে কবর যিয়ারত ও এর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এই বিধানগুলি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এখানে বিস্তারিতভাবে সেই নির্দেশনাবলী তুলে ধরা হলো:
কবর সংক্রান্ত নিষিদ্ধ কাজসমূহ:
- কবরে সিজদাহ করা: কবরকে সিজদাহ করা বা এর সামনে নত হওয়া ইসলামে কঠোরভাবে হারাম। (বুখারী: ১৩৩০)
- কবরকে মসজিদ বানানো: কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা বা কবরকে নামাজের স্থান বানানো নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহ ইহুদীদের উপর অভিশাপ করুন, তারা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে।” (আবু দাউদ: ৩২২৭, নাসায়ী: ২০৪৭)
- কবরের উপর বসা ও সালাত আদায়: কবরের উপর বসা, হেলান দেওয়া বা কবরের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা কবরের উপর বসবে না এবং এর দিকে মুখ করে সালাত আদায় করবে না।” (মুসলিম: ২১৪০, নাসায়ী: ২০৪৪)
- কবর পাকা করা ও মাজার বানানো: কবর ইট-সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা, চুনকাম করা বা তার উপর কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ করা হারাম। জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কবর পাকা করতে, তার উপর গৃহ নির্মাণ করতে এবং কবরের উপর বসতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম: ২১৩৫, আবু দাউদ: ৩২২৫, নাসায়ী: ২০২৮)
- কবরের উপর বাতি জ্বালানো: কবরের উপর মোমবাতি, আগরবাতি বা যেকোনো ধরনের বাতি জ্বালানো নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কবর যিয়ারতকারী নারী এবং যারা কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করে ও সেখানে বাতি জ্বালায় তাদের উপর অভিশাপ করেছেন। (নাসায়ী: ২০৪৩)
- কবরের উপর লেখা: কবরের উপর কোনো কিছু লেখা, বিশেষ করে মৃতের প্রশংসা বা কোরআনের আয়াত লেখা নিষেধ। (আবু দাউদ: ৩২২৬)
- কবরে ফলক লাগানো: নিছক পরিচয়ের জন্য কবরের পাশে নাম ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা সম্বলিত ফলক লাগানো জায়েজ, তবে অপ্রয়োজনীয় লেখা বা সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে ফলক লাগানো উচিত নয়। (তিরমিজি: ১০৫২)
- কবরে ওরস বা মেলা: কবরকে কেন্দ্র করে ওরস, মেলা বা কোনো প্রকার উৎসবের আয়োজন করা হারাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর নিজের কবরকে উৎসবের স্থানে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ: ২০৪২)
- উঁচু কবর সমতল করা: কোনো কবর মাটির চেয়ে বেশি উঁচু দেখলে তা ভেঙ্গে মাটির সমপরিমাণ করে দেওয়া ইসলামের নির্দেশ। রাসূল (ﷺ) হযরত আলী (রাঃ)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেকোনো উঁচু কবরকে ভেঙ্গে সমান করে দেওয়ার জন্য। (মুসলিম: ২১৩৩, নাসায়ী: ২০৩০, আবু দাউদ: ৩২১৮)
- কবরের পাশে পশু জবাই: কবরের পাশে বা কবরবাসীর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা নিষিদ্ধ। (আবু দাউদ: ৩২২২)
কবর যিয়ারত সংক্রান্ত বিধান:
- পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত: পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত করা সুন্নত। এটি মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আখিরাতের কথা চিন্তা করতে সাহায্য করে। একা একা হাত তুলে কবরবাসীর জন্য দোয়া করার অনুমতি রয়েছে। (মুসলিম: ২১৪৯, আবু দাউদ: ৩২৩৪, তিরমিজি: ১০৫৪)
- মহিলাদের কবর যিয়ারত: মহিলাদের কবর যিয়ারতের বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কিছু হাদিসে ঘন ঘন কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের প্রতি অভিসম্পাত করা হয়েছে। (তিরমিজি: ১০৫৬, ইবনে মাজাহ: ১৫৭৪) তবে, কিছু আলেম নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে (যেমন—পর্দা রক্ষা করা, কান্নাকাটি না করা) জায়েজ বলেছেন।
- যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর: কেবল তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা জায়েজ: মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও মসজিদে নববী। কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্তে সফর করা নিষেধ। (বুখারী: ১১৯৭)
উপসংহার:
ইসলাম কবরকে সম্মান প্রদর্শনের নামে শিরক ও বিদআতের সকল পথ বন্ধ করেছে। মদিনায় স্বয়ং নবী (ﷺ)-এর কবর এবং হাজার হাজার সাহাবীর কবর পাকা করা হয়নি, যা এই নির্দেশনাগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে।
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টি বিদআত, প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী এবং প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম।” (মুসলিম: ১৫৩৫, নাসাঈ: ১৫৬০)
যারা এই সুস্পষ্ট হাদিসগুলো জানার পরেও মাজার বা কবর কেন্দ্রিক নিষিদ্ধ কার্যাবলীতে লিপ্ত হয়, তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সকলকে সঠিক বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।



